Tuesday, June 17, 2025
এক দেহে হলো লীন -- কলকাতায় আর্মেনিয়ান অতিথি
এক দেহে হলো লীন -- কলকাতায় আর্মেনিয়ান অতিথি
উত্তর এশিয়া ঘেঁষা, ককেশীয় পর্বতের কোলে বসা আর্মেনিয়া দেশ, যার উত্তর-পূর্বে জর্জিয়া/আজারবাইজান ও দক্ষিণ-পশ্চিমে আছে ইরান/তুরস্ক। আর্মেনিয়ার দক্ষিণে মানব সভ্যতার শুরু হয়েছিল -- তুরস্ক ও আর্মেনিয়ার উচ্চভূমি থেকে উৎসারিত টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস নদীর মাঝে, পশ্চিম এশিয়ার মেসোপটেমিয়া সভ্যতা। সভ্যতার শুরুতে ছিল যে বর্ধিষ্ণু বিশাল আর্মেনিয়া (কৃষ্ণসাগরের মধ্যে-দক্ষিণ ও ভূমধ্য-সাগর থেকে ইরান পর্যন্ত ছড়ানো), ১৪শ শতাব্দীর পর সমানে আক্রান্ত হয়েছে অটোম্যান (উসমানীয় সাম্রাজ্য বা তুর্কি সাম্রাজ্য), পারস্য ও রাশিয়া দ্বারা -- রোমান, বাইজেন্টাইন, আরব, তুরস্ক, পারস্য, মঙ্গোল, জর্জিয়া, রাশিয়ার মধ্যে পালাক্রমে হাতবদল হয়েছে দেশটি। পশ্চিম আর্মেনীয়া দীর্ঘদিন অটোম্যান সাম্রাজ্যের দখলে ছিল। সে সময় তুর্কিরা আর্মেনীয়দের ওপর গণহত্যা চালায়, নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য তারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আশ্রয় নেয় আর ওই ভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আর্মেনীয়ানদের বসতি গড়ে ওঠে। আর্মেনিয়া সোভিয়েত সংঘের অন্তর্ভুক্ত হয় ১৯২০ সালে -- মিউনিসিপাল কলকাতার (৪৬ লক্ষ) থেকে অনেক কম জনবহুল (৩০ লক্ষ) দক্ষিণ ককেশীয় এই খৃষ্টান দেশটি ১৯৯১ সালে সর্বভৌমত্ব অর্জন করে, রাজধানী হলো ইয়েরেভান।
বিপরীত মানবপ্রবাহও হয়েছে। এক গবেষণায় (১৯০৪) বলা হয়েছে, দুই সর্দার (কিষান ও গনেশ) কনৌজের রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে পরাজিত হয়ে সদলবলে পশ্চিমে পালিয়ে আর্মেনিয়ার শাসকের আশ্রয় প্রার্থনা করে (১৪৯-১২৭ খ্রিস্টপূর্ব)। রাজা ভালারসাসে (Valarsaces) সেই কৃষ্ণাঙ্গ ও অনার্য ভারতীয়দের বর্তমান তুরস্কের তাঁরণ প্রদেশে (Tarôn) বসবাসের অনুমতি দেন -- ভিশাপ (Vishap) ছিল আর্মেনিয়ায় প্রথম ভারতীয় বসতির নাম। তারা ১২টি গ্রাম ছাড়াও , ইউফ্রেটিস নদী পর্যবেক্ষণ করা যায় এমন পাহাড়ী জায়গায় দুটি মন্দির স্থাপনা করে, সম্ভবতঃ সর্পের পূজার জন্য।
ভারতে আসা প্রথম আর্মেনীয়ান ছিলেন থমাস কানা, মালাবার তীরে পৌঁছান ৭৮০ ক্রিস্টাব্দে। আর্মেনীয় ভাষায ভারতীয় নগরগুলির ওপর গাইড বই প্রকাশিত হয়েছিল ১২ শতাব্দীতে। মধ্যযুগে আর্টাসা, মেটসবিন, ডেভিন (Artashat, Metsbin, Dvin) শহরে জমে উঠলো বিনিময় বানিজ্য -- ভারতের ব্যাপারীরা আর্মেনীয়ার দামী পাথর, ঔষধি, সূক্ষ্ম বুনুনির কাপড় কিনলো, বিনিময়ে দিলো চামড়া ও কাপড় ছাপানোর রঙ। আকবরের এক পত্নী (মনম জমানি বেগম) ছিল আর্মেনীয়ান, সেই থেকেই আর্মেনীয়াদের সাথে তার সদ্ভাব ছিল, তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, তাদের ব্যবসায়িক বুদ্ধি ও সততার প্রশংসা করতেন, বন্দুক বানানো বা ছাপানোর কাজে তাদের কুশলতার সাহায্য নিতেন। আকবরের আনুকূল্যে উত্তর ভারতে প্রথম খ্রিস্টীয় উপাসনা ঘর, আর্মেনিয়ান চ্যাপেল, আগ্রাতে (১৫৬২) নির্মিত হয়।
দাবী করা হয়, সম্রাট আকবরের সময়েই এই দক্ষিণ ককেশীয় বণিকরা কলকাতায় এসেছিলো, ব্রিটিশ ও ইস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানি আসার অনেক আগে, তারাই এই শহর স্থাপনা করেছিল। বস্তুতঃ, কলকাতা হাইকোর্টের (২০০৩) রায় অনুসারে, জব চার্ণক কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন না, কলকাতার কোনো জন্মতারিখ নেই। গবেষণা জানাচ্ছে, এক কবরের ওপর লেখা আছে " এটা হলো স্বর্গীয় দানশীল সুকিয়াসের (Sookias) পত্নী রেজাবীব (Rezabeebeh সমাধি, যার দেহান্ত হয়েছিল জুলাই ২১, ১৬৩০" -- অর্থাৎ, ইংরেজ আসার প্রায় ছয় দশক আগেই সুকিয়াস পরিবার কলকাতা ছিলেন (যদিও বিষয়টি বিতর্কিত)।
আকবর অনেক আর্মেনীয়ানকে উঁচু পদে বসিয়েছিলেন -- আব্দুল হাই (Abdul Hai) ছিল তার দরবারের প্রধান বিচারপতি, তার পুত্র কবি মির্জা জুল-কার্নাইন (Mirza Zul-Qarnain) নিযুক্ত হয়েছিল (১৬১৩) বাংলার কর সংগ্রাহক হিসেবে। ঔরংজেবের আদেশে মুর্শিদাবাদের সাঈদাবাদে বসেছিল আর্মেনীয়ানদের মহল্লা। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি বাংলায় আর্মেনীয়ানদের ব্যবসা এমন জমিয়ে বসেছিল যে, পরবর্তী কালে, তারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে বাংলায় ও কলকাতায় প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। হুগলীর বাসিন্দা ইজরায়েল সারহাদ (Israel Sarhad) দিল্লীর দরবারে খুব সম্মানিত ছিল -- তার বিশেষ দৌত্যেই সম্রাট আজেম-উশ-শান তার শাসকীয় ফরমান জারি করে (১৬৯৮) ব্রিটিশদের এ দেশে শাসন ও বাণিজ্যের সুযোগ করে দেন।
ষোড়শ শতকে পারস্য থেকে প্রভাবী আর্মানীয়ান বণিকেরা সে সময়ের ব্যস্ত বন্দর সুরাট, যার সাথে জলপথে বসরা ও বন্দর আব্বাসের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল, সেখানে উপস্থিত হলো ব্যবসায়ী স্বার্থে, সেখানে দুটি চার্চ ও একটি কবরস্থান নির্মাণ করলো, আর্মেনীয় ভাষায় লিখিত ও সেন্ট পিটার্সবুর্গের এক লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত এক পুঁথিতে এই ব্যাপারে কিছু বিবরণ উপলব্ধ আছে। ধীরে ধীরে তারা চিনসুরা, চন্দননগর, চুঁচুরা (বাংলা), আগ্রা ও লখনৌয়ে ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময় কলকাতা মাদ্রাস বম্বেতে মশলা, রেশম, নীল, লাক্ষা, জুয়েলারী, খনি ও মনি-রত্নের ব্যবসা ঘিরে আর্মেনিয়ানদের বসতির সূত্রপাত হয় -- তারা পশ্চিম এশিয়া থেকে পূর্বে ম্যানিলা পর্যন্ত ব্যাপার করতো।
মাদ্রাসে ১৭৭২ নাগাদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অনুমতিক্রমে নির্মাণ হলো সেখানের প্রথম চার্চ, সেখানেই প্রকাশিত (১৭৯৪) হলো “আজতারার” (Azdarar), প্রথম আর্মেনীয় জার্নাল। যদিও ইংরেজ ও ফরাসীদের মতোই বেশিরভাগ আর্মেনীয়ানই এসেছিলো ব্যবসা করতে, পার্শিয়ান ভাষা জানা ও ইসলামিক সংস্কৃতির সাথে পরিচিতির সুবাদে, তাদের কিছু অংশ ইউরোপীয় ট্রেডিং কোম্পানিগুলিতে দোভাষী (ফারসি, আরবি, উর্দু, ইংরেজি, বাংলা), প্রতিনিধি ও তথ্যদাতার কাজে জড়িত হয়েছিল। কলকাতাই তাদের ব্যবসায়ের মূল কেন্দ্র ছিল, আর্মেনিয়ান স্ট্রিট ঘিরে তারা বসবাস শুরু করে। কলকাতার তদানীন্তন সুপ্রিম কোর্টে জর্জ অ্যাভিয়েট (George Aviett) নামক আর্মেনীয়ান অনুবাদকের কাজ করেছেন বহু বছর -- তাঁর সমাধি আছে বড়বাজারের ব্র্যাবোর্ন রোডের আর্মেনীয়ান গির্জায়।
কাঠ দিয়ে বানানো Armenian Holy Church of Nazareth (১৬৮৮) এক বিশাল অগ্নিকান্ডে ১৭০৭ সালে ভষ্মীভূত হয়, তার জায়গায় নতুন চার্চ বানানো হয় বড়বাজারে, পুরানো আর্মেনীয়ান সমাধিক্ষেত্রে, আর্মেনিয়ান স্ট্রিটের কাছে -- কলকাতার সব চাইতে পুরানো ও বড় চার্চ (কলকাতায় তাদের আরও দুটি চার্চ আছে -- পূর্ব প্রান্ত ট্যাংরাতে Holy Trinity Armenian Church আর চিনসুরা/হুগলীতে St. John the Baptist Armenian Church).
হুগলি নদীর তীরে, পুরানো ব্রিজ ও মল্লিক বাজারের পাশে, আর্মেনিয়ান বা আর্মানি ঘাট (১৭৩৪) বানান ম্যানভেল হাজার ম্যালিয়ান (Manvel Hazaar Maliyan, লোকে ডাকতো হুজুরীমল বলে) বানান, তাদের ব্যবসায় যুক্ত নৌকাগুলি ভিড়ানোর জন্য, স্থানীয়রা স্নান ও পূজার জন্যও এই ঘাট ব্যবহার করতো। ইস্ট ইন্ডিয়া রেল কোম্পানীর হাওড়া-বালি-শ্রীরামপুর -হুগলী ফেরী সেবার প্রধান টিকেট ঘর এখানেই খোলা হয়েছিল, ১৮৭৩ সালে পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হয়েছিল ঘোড়ায় টানা প্রথম শিয়ালদহ-আর্মেনিয়া ঘাট ট্রাম।
কলকাতা ভুলেছে গ্যালস্টোনকে (Johannes Carapiet Galstaun) যে এখন চিরনিদ্রায় আর্মেনীয়ান চার্চের কবরস্থানে শায়িত -- ঘোড়দৌড়ের জুয়াড়ীদের অতিপ্রিয় বাজি জেতা ঘোড়া "Gateway Gate" ছাড়াও তার ছিল একশ অন্য রেসের ঘোড়া। শহরের সেরা জকি এবং রেসকোর্সের অধিপতি হওয়ার পাশাপাশি, গ্যালস্টন একজন বিখ্যাত রিয়েল-এস্টেট ডেভেলপার ছিলেন, ছিল দামী দামী গাড়ি, শহরের প্রায় ৩০০ ইমারতের মালিকানা। সেনা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্লট লিজ নিয়ে অনেক আবাসিক প্রকল্প বানিয়েছিলেন। আচার্য জগদীশ চন্দ্র বোস রোডের এখনকার নিজাম প্যালেস আসলে ছিল গ্যালস্টোন পার্ক, প্রিয় স্ত্রী রোজ ক্যাথরিনের জন্য বানিয়েছিলেন গ্যালস্টোন। প্রিন্স অফ ওয়েলস (রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড) কলকাতা সফরে নজর কাড়া এই প্রাসাদেই থাকতেন। কি ভাবে বিনা নথিপত্রে হায়দ্রাবাদের নিজাম মীর ওসমান আলী খান এই সম্পত্তির মালিকানা পেয়েছিলেন (১৯৩৩) জানা নেই, বলা হয় গ্যালস্টোন তাসের জুয়ায় এটা হেরেছিলেন নিজামের কাছে। পরে ভারত সরকার প্রাসাদটি অধিগ্রহণ করে, বর্তমানে এটি CPWD, CBI যেমন কয়েকটি সরকারী দপ্তর এখানে স্থিত। গ্যালস্টোনের স্মৃতি নিয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে পার্ক স্ট্রিটের ফ্রিম্যাসন'স লজ, স্যাটারডে ক্লাব, হো-চি-মিন সরণির হ্যারিংটন ম্যানশন, ডালহৌসি ইনস্টিটিউট, রাসেল স্ট্রিটের রয়েল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব ভবন, পার্ক স্ট্রিট - রাসেল স্ট্রিট ক্রসিংয়ের গ্যালস্টোন ম্যানশন (১৯৬১ সালে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের কলকাতা সফরের স্মরণে নাম বদলে কুইন্স ম্যানশন রাখা হয়)। সেন্ট জোসেফ হাসপাতালকে ও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল নির্মাণ তহবিলে আর্থিক সাহায্য করা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের চিকিৎসার জন্য প্রাসাদের জমিতে অস্থায়ী হাসপাতাল তৈরি করা --এই সবের জন্যও লোকে গ্যালস্টোনকে মনে রাখবে।
অ্যারাটুন স্টিফেন (Arathoon Stephen) ছিলেন কলকাতার আরও এক ধনী আর্মেনিয়ান, স্টিফেন কোর্টের প্রথম ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও আংশিক মালিক, উনিই গ্রান্ড হোটেল (কলকাতা) ও এভারেস্ট হোটেল (দার্জিলিং) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পাটের ব্যবসায়ী থাডিউস (TM Thaddeus) ১৯০১ সালে বানিয়েছিলেন পার্ক ম্যানসন (১৯৪৮-তে এপেজি সুরেন্দ্র গ্রুপের হাতে মালিকানা বদলায়)। অ্যাস্টর, লিটন, কেনিলওয়ার্থ প্রভৃতি হোটেল আর্মেনিয়ানদের বানানো।
সুকিয়া স্ট্রিট, আর্মেনিয়ান স্ট্রিট, হুজুরিমল ট্যাঙ্ক লেন, সুকিয়াস লেন, আহিরীটোলা, আর্মানিটোলা, আর্মানিপাড়া -- এইগুলি কলকাতার আর্মেনীয়ানদের অঞ্চল ছিল। বহু বছর কলকাতার সংস্কৃতির সাথে মেলা মেশার জন্য তাদের রান্নাও বাঙালীর হেঁসেলে স্থান পেয়েছে -- বলা হয়, আমাদের পটলের দোরমা/দোলমা তুরস্কের ব্যঞ্জন "ডোলমার্ক" (Dolmark) অনুসরণে হয়েছে (তারা এর ভেতরে মাংসের পুর দেয়)।
গৌরবকালে তারা আর্মেনীয়ান কলেজ (Armenian College and Philanthropic Academy, ACPA) (মির্জা গালিব স্ট্রিট) ও আর্মেনিয়ান স্পোর্টস ক্লাব (মেয়ো রোড) পরিচালনা করেছে এবং স্থানীয় কলা সংস্কৃতিতে অংশ গ্রহণ করেছে। ভারতে ব্রিটিশ-বর্জিত প্রথম রাগবী দল আর্মেনিয়ানরাই বানিয়েছিলো দেড়শো বছর আগে, তারাই দেশে বিদেশে এ দেশের রাগবী প্রতিনিধিত্ব করেছে। কলকাতার হকি লীগে আর্মেনিয়ানরা গত শতকের সত্তর পর্যন্ত ভাগ নিয়েছে। ধ্যানচাঁদের অলিম্পিক জয়ী (১৯৩৬) হকি দলের ডানদিকের হাফ-ব্যাক ছিলেন গালিবারডি (Joseph Galibardy), পরে ইংল্যান্ডে চলে যান, গত বছর প্রয়াত হয়েছেন সেখানে ৯৬ বছর বয়েসে। কলকাতা সে খবর রাখেনি। এক ক্রিষ্টান আর্মেনীয়ান পিতার কন্যা ছিল আইলিন অ্যাঞ্জেলিনা ইয়োওয়ার্ড (Eileen Angelina Yeoward), তার মায়ের মতোই সুন্দর গান গাইতো, সে-ই ভারতে প্রথম গ্রামাফোনে রেকর্ড করেছিল, পরবর্তী কালে লোকে তাকে (ধর্ম পরিবর্তনে?) কলকাতার গৌহর জান পরিচয়ে জানতো।
ভারতের স্বাধীনতার তিন দশক আগেও কলকাতায় আর্মেনীয়ানদের সংখ্যা প্রায় ২০০০ ছিল। স্বাধীনতার পর তাদের ব্যবসায় মন্দা আসলো, খনির জাতীয়করণ হলো, ব্যবসায় মাড়োয়ারীদের প্রভাব বাড়তে লাগলো। জীবিকা ও সুযোগের সংকোচের কারণে তাদের নতুন প্রজাতি পাড়ি দিল ইংল্যান্ড অস্ট্রেলিয়ায়, বর্তমানে একশোর মতো আর্মেনীয়ান কলকাতায় অবশিষ্ট রয়েছে অতীতের স্মৃতি বহন করে, বেশিরভাগই বয়স্ক, চার্চ সঞ্চালিত বৃদ্ধাশ্রম (The Sir Catchick Paul Chater Home) তাদের আশ্রয়, চার্চই তাদের সংহতির কেন্দ্রবিন্দু -- তারা প্ৰতিবছর ২৪ এপ্রিল Armenian Genocide Remembrance Day উদযাপন করে, আর খ্রীষ্টমাস পালন করে জানুয়ারীর ৬ তারিখে।
কিছু বিষয় এই লেখায় উল্লেখ নেই। যেমন, তদানীন্তন দিল্লী-কোম্পানী-নবাবদের ক্ষমতা দখলের দাবা খেলায় নিজ ব্যবসা-স্বার্থ রক্ষায় আর্মেনীয়নদের ভূমিকা, যে খেলা পলাশী পর্যন্ত পৌঁছেছিল -- ইন্টারনেটে এ ব্যাপারে অনেক তথ্য পাবেন। আরো জানতে পারবেন বাংলা সাহিত্য ও নাটকে আর্মেনীয় চরিত্র, আর্মেনীয় সমাজ এবং তাদের প্রতিষ্ঠিত স্থানাদির অস্তিত্ব -- গিরিশচন্দ্র ঘোষের সিরাজদ্দৌলা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহজ পাঠ (দ্বিতীয় ভাগ), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস শ্যাম সাহেব, মহাশ্বেতা দেবীর কিশোর উপন্যাস আরমানি চাঁপার গাছ, সুচিত্রা ভট্টাচার্যের মিতিন মাসি গোয়েন্দা সিরিজের গল্প, কালীপ্রসন্ন সিংহের হুতোম প্যাঁচার নকশা আদিতে উদাহরণ পাবেন।
আর্মেনীয়ান ও অধুনা বাংলাদেশ
মুঘল আমলে ভাগ্য বদলাতে অল্পসংখ্যক আর্মেনিয়ান ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করে, তাদের সেই অঞ্চল আর্মেনীটোলা নামে পরিচিত (বর্তমানে ঢাকায় তাদের বংশদ্ভূত কয়েকটি পরিবার রয়েছে বলা হয়)। অষ্টাদশ ও উনিশ শতকের প্রথমার্ধে অতিক্ষুদ্র একটি সম্প্রদায় হওয়া সত্ত্বেও ঢাকা শহরে আর্মেনীরা ছিলো যথেষ্ট বিত্তবান ও প্রভাবশালী -- অষ্টাদশ শতকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তার একচেটিয়া লবণ উৎপাদন ও বিতরণের জন্য যে ঠিকাদার নিয়োগ করতো, পূর্ববঙ্গে তাদের অধিকাংশই ছিল আর্মেনী। ঠিকাদারি ছাড়াও পান, পাট ও কাপড়ের ব্যবসায় ছিলো তাদের -- চা, মদ, ইউরোপীয় জিনিসপত্র, ব্যাংক ইত্যাদিতেও তারা লিপ্ত ছিল। জমিদারীও ছিলো।
পুরনো ঢাকার আর্মেনীটোলায় ১৭৮১-এর আর্মেনিয়ান চার্চ (Armenian Church) রয়েছে, সেখানে এক সময় ছিলো তাদের কবরস্থান। জনৈক ক্যাটচিক আভেটিক থমাসের সমাধির ওপর তাঁর স্ত্রী কলকাতা থেকে কিনে এনে বসিয়েছিলেন সুন্দর এক মূর্তি, যা এখনো আছে --সমাধিস্তম্ভে উৎকীর্ণ বাণীতে স্বামীকে উল্লেখ করেছিলেন ‘বেস্ট অব হাজব্যান্ডস’বলে। গীর্জা নির্মাণের জন্য গোরস্থানের আশেপাশে জমি দান করেছিলেন আগা মিনাস ক্যাটচিক, নির্মাণে সাহায্য করেছিলেন মাইকেল সার্কিস, অকোটাভাটা সেতুর সিভর্গ এবং মার্কার পোগজ। চার্চের পাশে, জোহানস কারু পিয়েত সার্কিস দ্বারা নির্মিত, ঘড়িঘরটির ঘণ্টার শব্দ শুনেই নাকি ঢাকাবাসী নিজ নিজ ঘড়ির সময় ঠিক করে নিতেন -- ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে সেটা ভেঙে গিয়েছিলো, আর বাজেনি। ঐতিহ্যবাহী গীর্জাটির এখন রক্ষণাবেক্ষণ করে টিঁকে থাকা কয়েকজন আর্মেনিয়ান।
উনিশ শতকের ঢাকায় পরিচিত ও প্রভাবশালী আর্মেনীয়ান পরিবার ছিল পোগস, আরাতুন, পানিয়াটি, স্টিফান, লুকাস, কোজা মাইকেল, মানুক, হার্নি, সিরকোর এবং সার্কিস। তারা নিজেদের থাকার জন্য তৈরি করেছিলেন প্রাসাদতুল্য সব বাড়ি - - ফরাসগঞ্জের বর্তমান রূপলাল হাউস ছিলো আরাতুনের, মানুক থাকতেন সদরঘাটে, বর্তমানের ‘বাফা ছিল নিকি পোগজের, আর্মেনীটোলায় নির্মিত হয়েছিলো ‘নিকি সাহেবের কুঠি’, আনন্দরায় স্ট্রিটে ছিল স্টিফানের বাড়ি, তাজমহল সিনেমা ছিল পানিয়াটির অট্টালিকা। নিকি পোগজ প্রতিষ্ঠা করেন পোগজ স্কুল, আরাতুন ছিলেন ঢাকা নর্মাল স্কুলের অধ্যক্ষ, ঢাকার প্রথম মিউনিসিপ্যাল কমিটিতে ছিলেন সার্কিস, ১৮৭৪-৭৫ সালে ঢাকা পৌরসভার নয়জন কমিশনারের মধ্যে দুইজন ছিলেন আর্মেনীয়ান -- জে.জি. এন পোগজ এবং এন.পি. পোগজ। সিরকোরই ঢাকায় প্রথম (১৮৫৬) ঘোড়ার গাড়ি (ঠিকা গাড়ি) চালু করেন, পরবর্তীকালে সেটাই ঢাকার প্রধান যানবাহন হয়। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে অনেকে জমিদারি বিক্রি করে ব্যবসার জন্য কলকাতায় চলে যান, তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি হ্রাস পেতে থাকে।
References:
--- https://archive.roar.media/.../armenia-a-country-of...
--- https://usanasfoundation.com/civilisational-linkages...
Are the Armenians the founders of Calcutta? A new book asks this question, Alakananda Nag Armenian Weekly, January 5, 2022
--- https://puronokolkata.com/.../armenian-ghat-calcutta-1734/
--- https://www.peopleofar.com/.../gauhar-jaan-armenian-lady.../
--- https://www.telegraphindia.com/.../jockey-to.../cid/1940821
--- In Calcutta, Armenians have been reduced from prominence to obscurity, Surajeet Das Gupta, India Today, Mar 31, 1988
--- https://www.theestablished.com/.../why-the-armenian...
--- Sircar, Jawhar. Job charnock or the Armenians: Who Founded Calcutta? The Sunday Statesman. 25th August 1985.
--- Hatpakha ISSN: 2321-3035, কেবলই বণিক নাকি আরও কিছু? By Suman Pal -February 11, 2021
--- বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন, ঢাকা জেলা, আর্মেনিয়ান চার্চ
Subscribe to:
Posts (Atom)