Tuesday, June 17, 2025

এক দেহে হলো লীন -- কলকাতায় আর্মেনিয়ান অতিথি

এক দেহে হলো লীন -- কলকাতায় আর্মেনিয়ান অতিথি উত্তর এশিয়া ঘেঁষা, ককেশীয় পর্বতের কোলে বসা আর্মেনিয়া দেশ, যার উত্তর-পূর্বে জর্জিয়া/আজারবাইজান ও দক্ষিণ-পশ্চিমে আছে ইরান/তুরস্ক। আর্মেনিয়ার দক্ষিণে মানব সভ্যতার শুরু হয়েছিল -- তুরস্ক ও আর্মেনিয়ার উচ্চভূমি থেকে উৎসারিত টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস নদীর মাঝে, পশ্চিম এশিয়ার মেসোপটেমিয়া সভ্যতা। সভ্যতার শুরুতে ছিল যে বর্ধিষ্ণু বিশাল আর্মেনিয়া (কৃষ্ণসাগরের মধ্যে-দক্ষিণ ও ভূমধ্য-সাগর থেকে ইরান পর্যন্ত ছড়ানো), ১৪শ শতাব্দীর পর সমানে আক্রান্ত হয়েছে অটোম্যান (উসমানীয় সাম্রাজ্য বা তুর্কি সাম্রাজ্য), পারস্য ও রাশিয়া দ্বারা -- রোমান, বাইজেন্টাইন, আরব, তুরস্ক, পারস্য, মঙ্গোল, জর্জিয়া, রাশিয়ার মধ্যে পালাক্রমে হাতবদল হয়েছে দেশটি। পশ্চিম আর্মেনীয়া দীর্ঘদিন অটোম্যান সাম্রাজ্যের দখলে ছিল। সে সময় তুর্কিরা আর্মেনীয়দের ওপর গণহত্যা চালায়, নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য তারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আশ্রয় নেয় আর ওই ভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আর্মেনীয়ানদের বসতি গড়ে ওঠে। আর্মেনিয়া সোভিয়েত সংঘের অন্তর্ভুক্ত হয় ১৯২০ সালে -- মিউনিসিপাল কলকাতার (৪৬ লক্ষ) থেকে অনেক কম জনবহুল (৩০ লক্ষ) দক্ষিণ ককেশীয় এই খৃষ্টান দেশটি ১৯৯১ সালে সর্বভৌমত্ব অর্জন করে, রাজধানী হলো ইয়েরেভান। বিপরীত মানবপ্রবাহও হয়েছে। এক গবেষণায় (১৯০৪) বলা হয়েছে, দুই সর্দার (কিষান ও গনেশ) কনৌজের রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে পরাজিত হয়ে সদলবলে পশ্চিমে পালিয়ে আর্মেনিয়ার শাসকের আশ্রয় প্রার্থনা করে (১৪৯-১২৭ খ্রিস্টপূর্ব)। রাজা ভালারসাসে (Valarsaces) সেই কৃষ্ণাঙ্গ ও অনার্য ভারতীয়দের বর্তমান তুরস্কের তাঁরণ প্রদেশে (Tarôn) বসবাসের অনুমতি দেন -- ভিশাপ (Vishap) ছিল আর্মেনিয়ায় প্রথম ভারতীয় বসতির নাম। তারা ১২টি গ্রাম ছাড়াও , ইউফ্রেটিস নদী পর্যবেক্ষণ করা যায় এমন পাহাড়ী জায়গায় দুটি মন্দির স্থাপনা করে, সম্ভবতঃ সর্পের পূজার জন্য। ভারতে আসা প্রথম আর্মেনীয়ান ছিলেন থমাস কানা, মালাবার তীরে পৌঁছান ৭৮০ ক্রিস্টাব্দে। আর্মেনীয় ভাষায ভারতীয় নগরগুলির ওপর গাইড বই প্রকাশিত হয়েছিল ১২ শতাব্দীতে। মধ্যযুগে আর্টাসা, মেটসবিন, ডেভিন (Artashat, Metsbin, Dvin) শহরে জমে উঠলো বিনিময় বানিজ্য -- ভারতের ব্যাপারীরা আর্মেনীয়ার দামী পাথর, ঔষধি, সূক্ষ্ম বুনুনির কাপড় কিনলো, বিনিময়ে দিলো চামড়া ও কাপড় ছাপানোর রঙ। আকবরের এক পত্নী (মনম জমানি বেগম) ছিল আর্মেনীয়ান, সেই থেকেই আর্মেনীয়াদের সাথে তার সদ্ভাব ছিল, তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, তাদের ব্যবসায়িক বুদ্ধি ও সততার প্রশংসা করতেন, বন্দুক বানানো বা ছাপানোর কাজে তাদের কুশলতার সাহায্য নিতেন। আকবরের আনুকূল্যে উত্তর ভারতে প্রথম খ্রিস্টীয় উপাসনা ঘর, আর্মেনিয়ান চ্যাপেল, আগ্রাতে (১৫৬২) নির্মিত হয়। দাবী করা হয়, সম্রাট আকবরের সময়েই এই দক্ষিণ ককেশীয় বণিকরা কলকাতায় এসেছিলো, ব্রিটিশ ও ইস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানি আসার অনেক আগে, তারাই এই শহর স্থাপনা করেছিল। বস্তুতঃ, কলকাতা হাইকোর্টের (২০০৩) রায় অনুসারে, জব চার্ণক কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন না, কলকাতার কোনো জন্মতারিখ নেই। গবেষণা জানাচ্ছে, এক কবরের ওপর লেখা আছে " এটা হলো স্বর্গীয় দানশীল সুকিয়াসের (Sookias) পত্নী রেজাবীব (Rezabeebeh সমাধি, যার দেহান্ত হয়েছিল জুলাই ২১, ১৬৩০" -- অর্থাৎ, ইংরেজ আসার প্রায় ছয় দশক আগেই সুকিয়াস পরিবার কলকাতা ছিলেন (যদিও বিষয়টি বিতর্কিত)। আকবর অনেক আর্মেনীয়ানকে উঁচু পদে বসিয়েছিলেন -- আব্দুল হাই (Abdul Hai) ছিল তার দরবারের প্রধান বিচারপতি, তার পুত্র কবি মির্জা জুল-কার্নাইন (Mirza Zul-Qarnain) নিযুক্ত হয়েছিল (১৬১৩) বাংলার কর সংগ্রাহক হিসেবে। ঔরংজেবের আদেশে মুর্শিদাবাদের সাঈদাবাদে বসেছিল আর্মেনীয়ানদের মহল্লা। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি বাংলায় আর্মেনীয়ানদের ব্যবসা এমন জমিয়ে বসেছিল যে, পরবর্তী কালে, তারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে বাংলায় ও কলকাতায় প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। হুগলীর বাসিন্দা ইজরায়েল সারহাদ (Israel Sarhad) দিল্লীর দরবারে খুব সম্মানিত ছিল -- তার বিশেষ দৌত্যেই সম্রাট আজেম-উশ-শান তার শাসকীয় ফরমান জারি করে (১৬৯৮) ব্রিটিশদের এ দেশে শাসন ও বাণিজ্যের সুযোগ করে দেন। ষোড়শ শতকে পারস্য থেকে প্রভাবী আর্মানীয়ান বণিকেরা সে সময়ের ব্যস্ত বন্দর সুরাট, যার সাথে জলপথে বসরা ও বন্দর আব্বাসের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল, সেখানে উপস্থিত হলো ব্যবসায়ী স্বার্থে, সেখানে দুটি চার্চ ও একটি কবরস্থান নির্মাণ করলো, আর্মেনীয় ভাষায় লিখিত ও সেন্ট পিটার্সবুর্গের এক লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত এক পুঁথিতে এই ব্যাপারে কিছু বিবরণ উপলব্ধ আছে। ধীরে ধীরে তারা চিনসুরা, চন্দননগর, চুঁচুরা (বাংলা), আগ্রা ও লখনৌয়ে ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময় কলকাতা মাদ্রাস বম্বেতে মশলা, রেশম, নীল, লাক্ষা, জুয়েলারী, খনি ও মনি-রত্নের ব্যবসা ঘিরে আর্মেনিয়ানদের বসতির সূত্রপাত হয় -- তারা পশ্চিম এশিয়া থেকে পূর্বে ম্যানিলা পর্যন্ত ব্যাপার করতো। মাদ্রাসে ১৭৭২ নাগাদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অনুমতিক্রমে নির্মাণ হলো সেখানের প্রথম চার্চ, সেখানেই প্রকাশিত (১৭৯৪) হলো “আজতারার” (Azdarar), প্রথম আর্মেনীয় জার্নাল। যদিও ইংরেজ ও ফরাসীদের মতোই বেশিরভাগ আর্মেনীয়ানই এসেছিলো ব্যবসা করতে, পার্শিয়ান ভাষা জানা ও ইসলামিক সংস্কৃতির সাথে পরিচিতির সুবাদে, তাদের কিছু অংশ ইউরোপীয় ট্রেডিং কোম্পানিগুলিতে দোভাষী (ফারসি, আরবি, উর্দু, ইংরেজি, বাংলা), প্রতিনিধি ও তথ্যদাতার কাজে জড়িত হয়েছিল। কলকাতাই তাদের ব্যবসায়ের মূল কেন্দ্র ছিল, আর্মেনিয়ান স্ট্রিট ঘিরে তারা বসবাস শুরু করে। কলকাতার তদানীন্তন সুপ্রিম কোর্টে জর্জ অ্যাভিয়েট (George Aviett) নামক আর্মেনীয়ান অনুবাদকের কাজ করেছেন বহু বছর -- তাঁর সমাধি আছে বড়বাজারের ব্র্যাবোর্ন রোডের আর্মেনীয়ান গির্জায়। কাঠ দিয়ে বানানো Armenian Holy Church of Nazareth (১৬৮৮) এক বিশাল অগ্নিকান্ডে ১৭০৭ সালে ভষ্মীভূত হয়, তার জায়গায় নতুন চার্চ বানানো হয় বড়বাজারে, পুরানো আর্মেনীয়ান সমাধিক্ষেত্রে, আর্মেনিয়ান স্ট্রিটের কাছে -- কলকাতার সব চাইতে পুরানো ও বড় চার্চ (কলকাতায় তাদের আরও দুটি চার্চ আছে -- পূর্ব প্রান্ত ট্যাংরাতে Holy Trinity Armenian Church আর চিনসুরা/হুগলীতে St. John the Baptist Armenian Church). হুগলি নদীর তীরে, পুরানো ব্রিজ ও মল্লিক বাজারের পাশে, আর্মেনিয়ান বা আর্মানি ঘাট (১৭৩৪) বানান ম্যানভেল হাজার ম্যালিয়ান (Manvel Hazaar Maliyan, লোকে ডাকতো হুজুরীমল বলে) বানান, তাদের ব্যবসায় যুক্ত নৌকাগুলি ভিড়ানোর জন্য, স্থানীয়রা স্নান ও পূজার জন্যও এই ঘাট ব্যবহার করতো। ইস্ট ইন্ডিয়া রেল কোম্পানীর হাওড়া-বালি-শ্রীরামপুর -হুগলী ফেরী সেবার প্রধান টিকেট ঘর এখানেই খোলা হয়েছিল, ১৮৭৩ সালে পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হয়েছিল ঘোড়ায় টানা প্রথম শিয়ালদহ-আর্মেনিয়া ঘাট ট্রাম। কলকাতা ভুলেছে গ্যালস্টোনকে (Johannes Carapiet Galstaun) যে এখন চিরনিদ্রায় আর্মেনীয়ান চার্চের কবরস্থানে শায়িত -- ঘোড়দৌড়ের জুয়াড়ীদের অতিপ্রিয় বাজি জেতা ঘোড়া "Gateway Gate" ছাড়াও তার ছিল একশ অন্য রেসের ঘোড়া। শহরের সেরা জকি এবং রেসকোর্সের অধিপতি হওয়ার পাশাপাশি, গ্যালস্টন একজন বিখ্যাত রিয়েল-এস্টেট ডেভেলপার ছিলেন, ছিল দামী দামী গাড়ি, শহরের প্রায় ৩০০ ইমারতের মালিকানা। সেনা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্লট লিজ নিয়ে অনেক আবাসিক প্রকল্প বানিয়েছিলেন। আচার্য জগদীশ চন্দ্র বোস রোডের এখনকার নিজাম প্যালেস আসলে ছিল গ্যালস্টোন পার্ক, প্রিয় স্ত্রী রোজ ক্যাথরিনের জন্য বানিয়েছিলেন গ্যালস্টোন। প্রিন্স অফ ওয়েলস (রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড) কলকাতা সফরে নজর কাড়া এই প্রাসাদেই থাকতেন। কি ভাবে বিনা নথিপত্রে হায়দ্রাবাদের নিজাম মীর ওসমান আলী খান এই সম্পত্তির মালিকানা পেয়েছিলেন (১৯৩৩) জানা নেই, বলা হয় গ্যালস্টোন তাসের জুয়ায় এটা হেরেছিলেন নিজামের কাছে। পরে ভারত সরকার প্রাসাদটি অধিগ্রহণ করে, বর্তমানে এটি CPWD, CBI যেমন কয়েকটি সরকারী দপ্তর এখানে স্থিত। গ্যালস্টোনের স্মৃতি নিয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে পার্ক স্ট্রিটের ফ্রিম্যাসন'স লজ, স্যাটারডে ক্লাব, হো-চি-মিন সরণির হ্যারিংটন ম্যানশন, ডালহৌসি ইনস্টিটিউট, রাসেল স্ট্রিটের রয়েল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব ভবন, পার্ক স্ট্রিট - রাসেল স্ট্রিট ক্রসিংয়ের গ্যালস্টোন ম্যানশন (১৯৬১ সালে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের কলকাতা সফরের স্মরণে নাম বদলে কুইন্স ম্যানশন রাখা হয়)। সেন্ট জোসেফ হাসপাতালকে ও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল নির্মাণ তহবিলে আর্থিক সাহায্য করা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের চিকিৎসার জন্য প্রাসাদের জমিতে অস্থায়ী হাসপাতাল তৈরি করা --এই সবের জন্যও লোকে গ্যালস্টোনকে মনে রাখবে। অ্যারাটুন স্টিফেন (Arathoon Stephen) ছিলেন কলকাতার আরও এক ধনী আর্মেনিয়ান, স্টিফেন কোর্টের প্রথম ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও আংশিক মালিক, উনিই গ্রান্ড হোটেল (কলকাতা) ও এভারেস্ট হোটেল (দার্জিলিং) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পাটের ব্যবসায়ী থাডিউস (TM Thaddeus) ১৯০১ সালে বানিয়েছিলেন পার্ক ম্যানসন (১৯৪৮-তে এপেজি সুরেন্দ্র গ্রুপের হাতে মালিকানা বদলায়)। অ্যাস্টর, লিটন, কেনিলওয়ার্থ প্রভৃতি হোটেল আর্মেনিয়ানদের বানানো। সুকিয়া স্ট্রিট, আর্মেনিয়ান স্ট্রিট, হুজুরিমল ট্যাঙ্ক লেন, সুকিয়াস লেন, আহিরীটোলা, আর্মানিটোলা, আর্মানিপাড়া -- এইগুলি কলকাতার আর্মেনীয়ানদের অঞ্চল ছিল। বহু বছর কলকাতার সংস্কৃতির সাথে মেলা মেশার জন্য তাদের রান্নাও বাঙালীর হেঁসেলে স্থান পেয়েছে -- বলা হয়, আমাদের পটলের দোরমা/দোলমা তুরস্কের ব্যঞ্জন "ডোলমার্ক" (Dolmark) অনুসরণে হয়েছে (তারা এর ভেতরে মাংসের পুর দেয়)। গৌরবকালে তারা আর্মেনীয়ান কলেজ (Armenian College and Philanthropic Academy, ACPA) (মির্জা গালিব স্ট্রিট) ও আর্মেনিয়ান স্পোর্টস ক্লাব (মেয়ো রোড) পরিচালনা করেছে এবং স্থানীয় কলা সংস্কৃতিতে অংশ গ্রহণ করেছে। ভারতে ব্রিটিশ-বর্জিত প্রথম রাগবী দল আর্মেনিয়ানরাই বানিয়েছিলো দেড়শো বছর আগে, তারাই দেশে বিদেশে এ দেশের রাগবী প্রতিনিধিত্ব করেছে। কলকাতার হকি লীগে আর্মেনিয়ানরা গত শতকের সত্তর পর্যন্ত ভাগ নিয়েছে। ধ্যানচাঁদের অলিম্পিক জয়ী (১৯৩৬) হকি দলের ডানদিকের হাফ-ব্যাক ছিলেন গালিবারডি (Joseph Galibardy), পরে ইংল্যান্ডে চলে যান, গত বছর প্রয়াত হয়েছেন সেখানে ৯৬ বছর বয়েসে। কলকাতা সে খবর রাখেনি। এক ক্রিষ্টান আর্মেনীয়ান পিতার কন্যা ছিল আইলিন অ্যাঞ্জেলিনা ইয়োওয়ার্ড (Eileen Angelina Yeoward), তার মায়ের মতোই সুন্দর গান গাইতো, সে-ই ভারতে প্রথম গ্রামাফোনে রেকর্ড করেছিল, পরবর্তী কালে লোকে তাকে (ধর্ম পরিবর্তনে?) কলকাতার গৌহর জান পরিচয়ে জানতো। ভারতের স্বাধীনতার তিন দশক আগেও কলকাতায় আর্মেনীয়ানদের সংখ্যা প্রায় ২০০০ ছিল। স্বাধীনতার পর তাদের ব্যবসায় মন্দা আসলো, খনির জাতীয়করণ হলো, ব্যবসায় মাড়োয়ারীদের প্রভাব বাড়তে লাগলো। জীবিকা ও সুযোগের সংকোচের কারণে তাদের নতুন প্রজাতি পাড়ি দিল ইংল্যান্ড অস্ট্রেলিয়ায়, বর্তমানে একশোর মতো আর্মেনীয়ান কলকাতায় অবশিষ্ট রয়েছে অতীতের স্মৃতি বহন করে, বেশিরভাগই বয়স্ক, চার্চ সঞ্চালিত বৃদ্ধাশ্রম (The Sir Catchick Paul Chater Home) তাদের আশ্রয়, চার্চই তাদের সংহতির কেন্দ্রবিন্দু -- তারা প্ৰতিবছর ২৪ এপ্রিল Armenian Genocide Remembrance Day উদযাপন করে, আর খ্রীষ্টমাস পালন করে জানুয়ারীর ৬ তারিখে। কিছু বিষয় এই লেখায় উল্লেখ নেই। যেমন, তদানীন্তন দিল্লী-কোম্পানী-নবাবদের ক্ষমতা দখলের দাবা খেলায় নিজ ব্যবসা-স্বার্থ রক্ষায় আর্মেনীয়নদের ভূমিকা, যে খেলা পলাশী পর্যন্ত পৌঁছেছিল -- ইন্টারনেটে এ ব্যাপারে অনেক তথ্য পাবেন। আরো জানতে পারবেন বাংলা সাহিত্য ও নাটকে আর্মেনীয় চরিত্র, আর্মেনীয় সমাজ এবং তাদের প্রতিষ্ঠিত স্থানাদির অস্তিত্ব -- গিরিশচন্দ্র ঘোষের সিরাজদ্দৌলা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহজ পাঠ (দ্বিতীয় ভাগ), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস শ্যাম সাহেব, মহাশ্বেতা দেবীর কিশোর উপন্যাস আরমানি চাঁপার গাছ, সুচিত্রা ভট্টাচার্যের মিতিন মাসি গোয়েন্দা সিরিজের গল্প, কালীপ্রসন্ন সিংহের হুতোম প্যাঁচার নকশা আদিতে উদাহরণ পাবেন। আর্মেনীয়ান ও অধুনা বাংলাদেশ মুঘল আমলে ভাগ্য বদলাতে অল্পসংখ্যক আর্মেনিয়ান ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করে, তাদের সেই অঞ্চল আর্মেনীটোলা নামে পরিচিত (বর্তমানে ঢাকায় তাদের বংশদ্ভূত কয়েকটি পরিবার রয়েছে বলা হয়)। অষ্টাদশ ও উনিশ শতকের প্রথমার্ধে অতিক্ষুদ্র একটি সম্প্রদায় হওয়া সত্ত্বেও ঢাকা শহরে আর্মেনীরা ছিলো যথেষ্ট বিত্তবান ও প্রভাবশালী -- অষ্টাদশ শতকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তার একচেটিয়া লবণ উৎপাদন ও বিতরণের জন্য যে ঠিকাদার নিয়োগ করতো, পূর্ববঙ্গে তাদের অধিকাংশই ছিল আর্মেনী। ঠিকাদারি ছাড়াও পান, পাট ও কাপড়ের ব্যবসায় ছিলো তাদের -- চা, মদ, ইউরোপীয় জিনিসপত্র, ব্যাংক ইত্যাদিতেও তারা লিপ্ত ছিল। জমিদারীও ছিলো। পুরনো ঢাকার আর্মেনীটোলায় ১৭৮১-এর আর্মেনিয়ান চার্চ (Armenian Church) রয়েছে, সেখানে এক সময় ছিলো তাদের কবরস্থান। জনৈক ক্যাটচিক আভেটিক থমাসের সমাধির ওপর তাঁর স্ত্রী কলকাতা থেকে কিনে এনে বসিয়েছিলেন সুন্দর এক মূর্তি, যা এখনো আছে --সমাধিস্তম্ভে উৎকীর্ণ বাণীতে স্বামীকে উল্লেখ করেছিলেন ‘বেস্ট অব হাজব্যান্ডস’বলে। গীর্জা নির্মাণের জন্য গোরস্থানের আশেপাশে জমি দান করেছিলেন আগা মিনাস ক্যাটচিক, নির্মাণে সাহায্য করেছিলেন মাইকেল সার্কিস, অকোটাভাটা সেতুর সিভর্গ এবং মার্কার পোগজ। চার্চের পাশে, জোহানস কারু পিয়েত সার্কিস দ্বারা নির্মিত, ঘড়িঘরটির ঘণ্টার শব্দ শুনেই নাকি ঢাকাবাসী নিজ নিজ ঘড়ির সময় ঠিক করে নিতেন -- ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে সেটা ভেঙে গিয়েছিলো, আর বাজেনি। ঐতিহ্যবাহী গীর্জাটির এখন রক্ষণাবেক্ষণ করে টিঁকে থাকা কয়েকজন আর্মেনিয়ান। উনিশ শতকের ঢাকায় পরিচিত ও প্রভাবশালী আর্মেনীয়ান পরিবার ছিল পোগস, আরাতুন, পানিয়াটি, স্টিফান, লুকাস, কোজা মাইকেল, মানুক, হার্নি, সিরকোর এবং সার্কিস। তারা নিজেদের থাকার জন্য তৈরি করেছিলেন প্রাসাদতুল্য সব বাড়ি - - ফরাসগঞ্জের বর্তমান রূপলাল হাউস ছিলো আরাতুনের, মানুক থাকতেন সদরঘাটে, বর্তমানের ‘বাফা ছিল নিকি পোগজের, আর্মেনীটোলায় নির্মিত হয়েছিলো ‘নিকি সাহেবের কুঠি’, আনন্দরায় স্ট্রিটে ছিল স্টিফানের বাড়ি, তাজমহল সিনেমা ছিল পানিয়াটির অট্টালিকা। নিকি পোগজ প্রতিষ্ঠা করেন পোগজ স্কুল, আরাতুন ছিলেন ঢাকা নর্মাল স্কুলের অধ্যক্ষ, ঢাকার প্রথম মিউনিসিপ্যাল কমিটিতে ছিলেন সার্কিস, ১৮৭৪-৭৫ সালে ঢাকা পৌরসভার নয়জন কমিশনারের মধ্যে দুইজন ছিলেন আর্মেনীয়ান -- জে.জি. এন পোগজ এবং এন.পি. পোগজ। সিরকোরই ঢাকায় প্রথম (১৮৫৬) ঘোড়ার গাড়ি (ঠিকা গাড়ি) চালু করেন, পরবর্তীকালে সেটাই ঢাকার প্রধান যানবাহন হয়। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে অনেকে জমিদারি বিক্রি করে ব্যবসার জন্য কলকাতায় চলে যান, তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি হ্রাস পেতে থাকে। References: --- https://archive.roar.media/.../armenia-a-country-of... --- https://usanasfoundation.com/civilisational-linkages... Are the Armenians the founders of Calcutta? A new book asks this question, Alakananda Nag Armenian Weekly, January 5, 2022 --- https://puronokolkata.com/.../armenian-ghat-calcutta-1734/ --- https://www.peopleofar.com/.../gauhar-jaan-armenian-lady.../ --- https://www.telegraphindia.com/.../jockey-to.../cid/1940821 --- In Calcutta, Armenians have been reduced from prominence to obscurity, Surajeet Das Gupta, India Today, Mar 31, 1988 --- https://www.theestablished.com/.../why-the-armenian... --- Sircar, Jawhar. Job charnock or the Armenians: Who Founded Calcutta? The Sunday Statesman. 25th August 1985. --- Hatpakha ISSN: 2321-3035, কেবলই বণিক নাকি আরও কিছু? By Suman Pal -February 11, 2021 --- বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন, ঢাকা জেলা, আর্মেনিয়ান চার্চ

Wednesday, August 14, 2024

এই বর্ষায়

এই বর্ষায় ====== সেই আশির দশকে ভারতে এলো সুপার কম্পিউটার, কৃষির অগ্রগতিকে মদত করতে মৌসম বিভাগ জানালো এখন থেকে আর ৭-৮ টা না, প্রায় ৩২ টা variable বিশ্লেষণের ভিত্তিতে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেবে। ২০২৪ এর ভবিষৎবাণীতে ছিল খুব গরম পড়বে, পড়েও ছিল সারা দেশ জুড়ে, আহমেদাবাদেও। আলফানসো আম মে মাসের শুরুতে ১২০০-১৪০০ টাকা/ডজনে আবির্ভাব হলেও, দ্রুত পতন হয়েছিল তার বাজার দামে, সময় সামান্য এগোতেই এসেছিলো স্থানীয় কেশর আম। শহরে দিনরাত এয়ারকন্ডিশনার চলেছিল, কুকুর ও পাখিদের জন্য মিউনিসিপালিটি এখানে ওখানে সিমেন্টের গামলা রেখেছিলো, যাতে স্থানীয়রা তাতে জল দিতে পারে স্নান ও পানের জন্য। মাঝ দুপুরে রাস্তায় যান চলাচল প্রায় ছিলই না -- তাপমান ৩৩--৪৬ ডিগ্রীতে আটক ছিল --- স্কুলের সময় ও বদলে দেওয়া হলো সেই সাথে। জুনের মাঝ থেকে শুরু হলো কালো মেঘেদের ঘোরাঘুরি, সেই সুদূর দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে এসে পশ্চিমঘাট পার হয়ে ভারতের মূল ভূখণ্ডে তার প্রবেশ। আবহাওয়া অফিস বললো, তৈরী থাকো সবাই, এবারে কিন্তু দেরীতে হলেও মৌসুমী বর্ষা দেশে দাপাবে। সেই আশংকায় রাস্তার বড়ো নীম বাবুল পাকুড়ের ডাল ছাঁটা শুরু হল, কৃষ্ণচূঁড়াদের বরাতে জুটলো বাটি ছাঁট। আগে কখনো কখনো এমন হতো -- সিনেমা হলের সব আলো নিভিয়ে দেওয়া হলো, কিন্তু প্রজেক্টরের সামান্য গন্ডগোলে সিনেমা শুরু হতে দু-তিন মিনিট দেরি হতো। মেঘ তো আসলো, বাতাস ও উড়লো, কিন্তু বৃষ্টির দেখা নেই। মাঝ জুলাই পর্যন্ত চললো সেই মেঘে ঢাকা সব দিন, তারপরেই নামলো বর্ষা। পরেশ ধরের লেখা ও বেচু দত্তের "ওরে ও মাঝি" গানের একটা লাইন ছিল "কালো মেঘের ডানার ঝাঁকে ঝড়ের বাদুড় আকাশ ঢাকে" -- শেষ জুলাই থেকে শুরু হলো সেই আকাশ মল্লার গান -- পাখি গাছ সারা প্রকৃতি এমন মাথা নিচু করে রইলো যেন ০-৫ গোলে ফুটবল ম্যাচ হেরেছে, সদা মুখর ময়ূররাও সোলার প্যানেলের নিচে চুপটি বসে পেখম শুকাচ্ছে। গেটের ছাউনীতে আশ্রিত এক সারমেয় পরিবার -- মা তাদের যতই বারণ করে "ওরে আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে", তবুও বারবার ছুটে যাচ্ছে তিনটি ছানা বৃষ্টিতে ভিজতে। আরও একমাস চলবে বৃষ্টি, যদিও তার পরিমান ইতিমধ্যেই কমে আসছে। এখন অগস্টের মাঝামাঝি, আকাশে হালকা সাদা মেঘের ছোঁয়া ইতিউতি দেখা যাচ্ছে, প্রকৃতির ক্যানভাসে ঝলমল সবুজ ছড়িয়ে বর্ষা নিজেই এখন ক্লান্ত। বাসাভাঙা শালিকের ছানাটা এখন ছোট ডানা মেলতে শিখেছে, কল্কে কামিনীর মধু নিতে মৌমাছিরা সকাল থেকেই ছোটাছুটি করছে, বারান্দার টবে গোটা ছয়েক নবীন উচ্ছের মুখে হাসি। ওদিকে ধানের খেতে হালকা হলুদের ছোঁয়া লাগলো বলে, ল্যাংড়া আমের চালান কমে গেছে, বাজারে আসছে হরেক রঙের শাক-সব্জী। বাতাসে শীতের হালকা পরশ, বিছানায় রাতে পায়ের নিচে হালকা চাদর রাখার সময় এখন। শিববাবুর সঙ্গতি কম, স্বর্গের শহরতলী কৈলাসে সপরিবারে থাকেন। বছরে একবার পরিবার মায়ের বাড়ি যান সন্তানদের নিয়ে। যাবার তোড়জোড় অনেক আগে থেকেই করতে হয়, বিনা কারণে নয়। এক ছেলে কার্তিক ডিজানের শার্টপ্যান্ট ছাড়া পড়ে না, অন্যজনের ওই ব্যাপারে ঘ্যানোরপ্যানোর নেই., যা দেবে তাই পড়বে। এক মেয়ে সরস্বতী অনলাইন শপিংএ ঘরে পাহাড় বানায়, অন্যজন, নাম যার লক্ষী, সে সাধারণ তাঁতেই খুশী। তৈরী হতে ওই কার্তিক আর সরস্বতী যা সময় নেবে ওই সময়ে দশ জন তৈরী হয়ে যাবে -- তারা বাথরুমে ঢুকলে বেরোবে না, যখন বেরোবে তখন মনে হবে যেন সাবানের ফ্যাক্টরি থেকে বেরলো। ছেলে গনেশ পেয়েছে বাবার স্বভাব, সে বারান্দায় বালতিতে স্নান করে। শিববাবু যাতায়াতের খরচ তেমন দেন না -- সরস্বতী নিজের কার্ড দিয়ে অনলাইন পুষ্পক বুক করে, বছরের জমানো পয়সা লক্ষী তার মা কে দিয়ে দেয় বাকি খরচের জন্য। সেই ঠাকুর পরিবারও অধৈর্য হয়ে পড়ছে, কবে বৃষ্টির মৌসমের সমাপ্তি হবে আর তারা পুষ্পকে চড়বে। তারা জানালা দিয়ে দেখে -- নিচে, বহু দূরে, কাশফুল ফুটেছে কি না, ধান কাটা হচ্ছে কি না, মাটিতে ভোরের শিউলী আল্পনা দিয়েছে কি না, গাঁয়ের বৌ মাটির বাসনে নতুল চালের ফেনা ভাত বসিয়েছে কি না।

Tuesday, June 25, 2024

পিছন ফিরে দেখা

জলের দাগ ========= পূর্ববঙ্গের স্কুল ডেপুটি ইন্সপেক্টর ছিলেন দীননাথ সেন। উনি এবং আরও কয়েকজন প্রভাবশালী মিলে পুরান ঢাকা শহরের গেন্ডারিয়াতে অনেক জমি কিনেছিলেন -- পরে, তার নামেই পরিচিতি পায় গেন্ডারিয়ার প্রধান রাস্তা, দীননাথ সেন রোড। দীননাথের পুত্র আদিনাথ, সে তার পুত্র দিবানাথের সাথে বিবাহ দেন কবি রজনীকান্ত সেনের নাতনী রমা সেনের সাথে (পরবর্তীকালের কালজয়ী অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন নামে যাকে আমরা চিনি)। আমার পিতামহ ঈশ্বর বিপিন বিহারী গঙ্গোপাধ্যায়ের বসতভিটার ঠিকানা যখন ১৩,দীননাথ সেন রোড ছিল তখন বঙ্গভঙ্গ অবশ্যই হয়েছিল, কিন্তু ভারতভঙ্গ হয়নি। ভারতভঙ্গের প্রাক্কালে বিপিনবিহারীর পাঁচ পুত্রের একান্নবর্তী পরিবার ওই বাসস্থানের উত্তরাধিকারী ছিল। বাড়িতে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর অর্চনার নিমিত্তে পূজাগৃহ ছিল, যেখানে পরিবারের সবাই সন্ধ্যা-প্রার্থনায় হাজিরা দিয়ে মঙ্গল প্রার্থনা করতো। বাড়ির পাঁচিল ঘেঁষেই ছিল গেন্ডারিয়া গার্লস হাইস্কুলের সীমানা, বাড়ীর বড় ছেলেরা জগন্নাথ হলের রোজনামচা পেশ করতো নৈশভোজের সময়। দীননাথ সেন রোডেই ছিল অধ্যক্ষ যোগেশচন্দ্র ঘোষের সাধনা ঔষধালয় (১৯১৪), আয়ুর্বেদ ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান -- ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সৈনিকরা যোগেশবাবুকে হত্যা করে। পাটুয়াটুলীতে ছিল শ্রী আশুতোষ ধরের প্রতিষ্ঠান আশুতোষ লাইব্রেরী, তার প্রকাশনীর তালিকা বিশাল -- ভাষা সাহিত্য সঙ্গীত ইতিহাস লোকসাহিত্য ধৰ্ম -- সব বিষয়ে নানান প্রকাশনা ছিল, কলকাতা ও এলাহাবাদ থেকেও তাদের বই প্রকাশিত হতো। কিশোরে সাহিত্যের জনপ্রিয় মাসিক প্রকাশনী (১৯২২ প্রথম প্রকাশ) "শিশুসাথী" আশুতোষ লাইব্রেরীর বিশেষ পরিচিতি ছিল। আমার সোনাকাকা শ্রী বিনয় কুমার গঙ্গোপাধ্যায় আশুতোষ লাইব্রেরীর একজন সম্পাদক ছিলেন, নিয়মিত লিখতেন ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক কাহিনী। প্রচুর কিশোর সাহিত্য ও পাঠ্যপুস্তক সম্পাদনের জন্য কাকার নিজের সংগ্রহে যে সব বই ছিল, তার অনেকই উনি আমাকে উপহার দিতেন, ওনার দেওয়া বই থেকেই জেনেছি স্ত্রী-পরিধানে নূরজাহানের অবদান, দেখেছি পৃথিবীর "নীলকুন্তলা সাগরমেখলা রূপ" (বিভূতিভূষণ) -- ছোটবেলায় গুটি-বসন্ত থেকে আরোগ্যলাভের সময় ওনার দেওয়া ব্রিটানিয়া বিস্কুটের টিনের বাক্স অনেকদিন যত্ন করে রেখেছিলাম। সেন পরিবার, সাধনা ঔষধালয়, আশুতোষ লাইব্রেরী ঘিরে গেন্ডারিয়াতে বিদগ্ধজনের একটা আড্ডা বসতো, তাতে অন্য পেশায় থাকা বিশিষ্টরাও যোগ দিতেন। যেমন, জনপ্রিয় রহস্য কাহিনী লেখক ডাঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত (জন্মেছিলেন নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার ইটনায় ১৯১১ সালে) ছিলেন চর্ম রোগের একজন চিকিৎসকও। ওনার প্রথম গল্প "কালোভ্রমর" ও তার মূল চরিত্র কিরীট রায় বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের মাইলফলক মানা হয়, লিখেছেন আরও প্রায় ২০০ গল্প, অনেক সিনেমা ওনার গল্পের আধারে নির্মিত হয়েছিল (উল্কা, বাদশা, উত্তরফাল্গুনী, মায়ামৃগ, কোমলগান্ধার, নিশিপদ্ম ইত্যাদি)। জাদু সম্রাট পি.সি.সরকার (প্রতুল চন্দ্র সরকার, জন্ম ১৯১৩, গ্রাম অশেকপুর, টাঙ্গাইল) ছিলেন সেই আড্ডার আর এক সদস্য। এনারা সবাই আমাদের পারিবারিক হিতৈষী ছিলেন -- নীহারবাবু পরে দমদমে চেম্বার খোলেন, দরকারে আমরা যেতাম চিকিৎসার জন্য, জাদুকর প্রতুলবাবুর দরজা খোলা ছিল যে কোন সহায়তার জন্য আর অভাবনীয় সৌজন্য প্রকাশ করেছিলেন আদিনাথ -- যেহেতু গেন্ডারিয়ার বন্ধুরা (দেশ ভাগের ডামাডোলে) দীননাথ-রমার বিয়েতে হাজির ছিল না, উনি নিজে নতুন পুত্রবধূকে নিয়ে কলকাতায় বাড়ি বাড়ি ঘোরেন সামাজিকতা সারতে। টালীগঞ্জে সোনাকাকার বাড়িতেও এসেছিলেন। অনেক বছর বাদে সুচিত্রা সেনের ছবি দেখে সোনা কাকীমা বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, " এই মাইয়াটা আমাগো বাড়িতে আইছিলো না ?" (বড়দের মুখে শোনা গল্প ও কিছু গবেষনার আধারে লেখা, নিবন্ধে ভুল থাকা অবিচিত্র না) শ্যামলাসুন্দরীকে উৎসর্গ করে ======================== ১৮২৯-এ পাস হলো সতীদাহ বিরোধী কানুন, ওই বছরেই পাস হলো বালবিবাহ বিরোধী কানুন, (১৪ ও ১৮, যথাক্রমে মেয়ে ও ছেলের বিবাহযোগ্য বয়েস নির্ধারিত হলো), এগিয়ে ১৮৫৬-এ পাস হলো বিধবা পুনর্বিবাহ। শ্যামলাসুন্দরীর জন্ম আনুমানিক ১৮৯৫-১৯০০ সালের মধ্যে, ওপরের কোনো কানুনই তার জীবনস্রোত অন্য ধারায় নেয়নি। যখন তার পিতা, এক সদাচারী কুলীন ব্রাহ্মণ, যুগের ধারায় শ্যামলাসুন্দরীর বিবাহ দেন, তখন সে সদ্য কিশোরী, পাত্রও শেষ কৈশোরে। বিধাতার আশীর্বাদ ছিলনা সেই বিবাহে,শ্বশুরবাড়ি যাবার সময় আসার আগেই পাত্রের অকালমৃত্যু হয়, শ্যামলাসুন্দরী যৌবনের আগেই বৈধব্যকে মেনে নেয়। যদিও পিতা বিপিনবিহারী নিজে দ্বিতীয়বার দার-পরিক্রম করেন প্রথম স্ত্রীর দেহান্তের পর, মেয়ে শ্যামলাসুন্দরীর ক্ষেত্রে কিন্তু সামাজিক অনুশাসন মেনে তার পুনর্বিবাহের উদ্যোগ নেননি। শ্যামলাসুন্দরী রঙিন কাপড় পরিত্যাগ করে সাদা-কালো শাড়ীতে নিজেকে ঢাকলো, মাথার চুলের দৈর্ঘ্য কোমর ছেড়ে ঘাড় ছুঁলো, রঙিন চুড়ি মাটিতে আছড়ে ভেঙে, সব আভূষণ সে ত্যাগ করলো। শ্যামলাসুন্দরীর বাকি জীবন তার ঘরের চৌহুদ্দির মধ্যে কেটেছিল -- একটা চারপাই, ঠাকুরের সিংহাসন ও পূজার সামগ্রী, ঘরের কোনায় একটা আলনা। সে স্নান করতো না,কিন্তু প্রতি সকালে সে গায়ে-মাথায় তেল মেখে একটা ভিজে গামছা দিয়ে সযত্নে সর্বাঙ্গ পুঁছতো, শেষে হাতে গলায় চোখের পাতায় কপালে চন্দনের প্রলেপ দিতো -- তার ঘরে ঢুকলেই একটা স্বর্গীয় পরিবেশ অনুভব করা যেত -- চন্দন ফুল শসা-কমলার গন্ধ মিশে যেত মহাভৃঙ্গরাজের গন্ধের সাথে। পিতলের বালগোপাল ছিল তার সারাক্ষনের সঙ্গী, তার স্নান পূজা খাওয়া শোয়াতেই সে সময় কাটাতো। জানি না শ্যামলাসুন্দরী ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখতো কি না, কিম্বা অবসরে ফিরে যেত কিনা তার শৈশবের দিনগুলিতে -- সে এমন অতীত যাকে ফিরে পাওয়া যাবে না, আর আছে এই বর্তমান যার শেষের ঠিকানা নেই। শ্যামলাসুন্দরী আমার পিসীমা ছিলেন। অনেক বর্ণহীন বসন্ত পেরিয়ে, প্রায় ৭০ বছর বয়েসে ইহলোক ত্যাগ করেন, বিনা কোনো অভিযোগ অনুযোগ। পূরবী'বৌদির জন্য =============== মা আমাকে "খোকা" বলে ডাকতেন, যা শুনে বাবা কৌতুকভরে বলতেন, "আহা,বুইড়া পোলা, তার নাম খোকা"। পিতৃপক্ষের স্বজনদের মধ্যে কেবলমাত্র উনিই আমাকে "খোকা" বলে ডাকতেন, পূরবী বৌদিকে মনে রাখার এটাই একমাত্র কারণ নয়। আমার সোনা'কাকার দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠপুত্র দিলীপকুমার (ওর্ফে "দিলু'দা), তার সহধর্মিনী ছিলেন পূরবী। দাদা ঠান্ডা মাথার লোক, মুখে হাসি লেগে থাকতো কঠিন তর্কের মধ্যেও, ছিলেন রসিক ও উদার মানসিকতার লোক। পূরবীবৌদি অন্য বৌদিদের থেকে কিছুটা ব্যতিক্রমী ছিলেন, মিল একটাই ছিল -- সব বৌদিরাই ছিলেন সুশীলা, নম্র, স্নেহময়ী। উনি পশ্চিম-বঙ্গীয় পরিবারের মেয়ে, সম্ভবতঃ আমাদের "বাঙাল" পরিবারে প্রথম "ঘটি" অনুপ্রবেশকারী ছিলেন -- তারটা ওখানেই কিছুটা বেসুরে বাঁধা হয়েছিল। আমি তখন সম্ভবতঃ মাধ্যমিকের চৌকাঠ পেরিয়েছি। উজ্জ্বল গায়ের রং, দীর্ঘ কুন্তলা, দীর্ঘাঙ্গী বৌদি কলেজের সফল সাঁতারু ছিলেন, সময়ের হিসেবে চলাফেরা কথাবার্তায় সপ্রতিভ ছিলেন। আমার ওনাকে সমীহ করার একটা অতিরিক্ত কারণ ছিল -- ওনার দাদা পুলিশ সার্জেন্ট ছিলেন, সাদাশার্ট প্যান্ট, কোমরে চওড়া বেল্টে পিস্তল গোঁজা, মাথায় কালো ক্যাপ পরে লাল মোটর সাইকেল চালিয়ে ডিউটিতে যেতেন। বৌভাতের দিন তত্ব আসলো বৌয়ের বাড়ি থেকে, বিশাল রুই মাছ দেখে বৌদি আনন্দের উত্তেজনায় আবদার করে বসলেন নিজের হাতে মাছটি কাটার। ঘেরা বারান্দায় তার সেই হাঁটুর ওপর কাপড় গুটিয়ে বঁটিতে মাছ কাটার দৃশ্য দেখে হটাৎ হাজির শাশুড়ির চোখ কপালে, আর্তনাদ করে বললেন, "নতুন বৌ এইটা কি করতেসে !!" -- আমার মা'র মধ্যস্থতায় অবস্থা শান্ত হয় কিন্তু ততক্ষনে দ্বিজাতি-তত্ব শিকড় গেড়ে নিয়েছে। দিলু'দার কর্মক্ষেত্র ছিল রাউরকেল্লা, স্টিল প্লান্টের লোকোমোটিভ বিভাগের দ্বায়িত্বে ছিলেন। সেখানেই একবার তাদের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম, প্রায় এক মাস ছিলাম রাউরকেল্লায়। সকালে দুই ছোট মেয়ে স্কুল চলে যেত, দাদাও হয়তো দিনের ডিউটিতে গেছেন -- ঘরের কাজের শেষে সারা দুপুর বৌদির সাথে গল্প আড্ডা গান ঠাট্টায় অলস সময় কেটে যেতো। বিকেল না আসতেই স্কুল ফেরত দুই কন্যার সাথে বৌদির রুটিন কথোপকথন -- "টিফিন সবটা খেয়েছো? জুতো এত ময়লা কেন? শার্ট এ কালির দাগ কেমন করে লাগলো ? ম্যাডাম নোটবুক চেক করেছিল ?” চাকরি জীবনে ভিনদেশে চলে যাবার পর আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ বিশেষ উপলক্ষ্য ছাড়া হতো না, বৌদির সাথেই বেশি কথা হতো টেলিফোনে। কর্মাবসনে দাদা কলকাতায় ফেরত যান, আমি কলকাতায় ছুটিতে গেলে তাদের সাথে অবশ্যই দেখা করতাম, বৌদির হাতের রান্না খেতাম। বৌদির কপট ধমকি, পূর্ববঙ্গীয় ঢঙে কথা বলে আমোদ দেবার চেষ্টা, জীবনের সুখ-দুঃখের কথা শুনতে শুনতে তিন-চার ঘণ্টা অপলকে কেটে যেত। অনেকদিন কথাবার্তা নেই, হটাৎ এক সকালে বৌদির টেলিফোন -- "জানো খোকা, হটাৎ লোকটা কাল সকালে চলে গেলো"। শুনে মন খারাপ হবারই কথা, কেননা মেয়েদের তখন বিয়ে হয়ে গেছে, তাকে এখন একাই থাকতে হবে। সেই সময় বেশিরভাগ টেলিফোনের আলোচনা ব্যাঙ্ক-পোস্টঅফিস, আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিয়েই হতো, সম্পর্কে বৈষয়িক আলোচনা প্রাধান্য পেতে শুরু করলো। আরও সামান্য কয়েকটা বছর পেরোতেই একদিন আমার টেলিফোনের উত্তর দিলো বৌদির বড়ো মেয়ে, " মা তো মারা গেছেন কিছুদিন আগে"। এই লেখার একটা কারণ আছে. বহুদিন ধরেই সড়কপথে আহমেদাবাদ থেকে কলকাতা যাবার ইচ্ছে আছে, বয়েস বাড়ার সাথে সাথে ইচ্ছাটা আরো প্রবল হয়েছে, আপাততঃ তুঙ্গে আছে -- সামনের মে মাসের যাত্রা এখন পাকা। ম্যাপ খুলে সম্পূর্ণ যাত্রাপথ নির্ধারণ করতে বসে একটা বিকল্পে আসলো "রাউরকেল্লা"। সাথে সাথে ফ্লাশব্যাকে মনে পড়ে গেলো সেই দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে যাবার সড়ক, দাদার কোয়ার্টারের অদূরের সেই পাথুরে ঢিপি, সেই অবকাশের দুপুর আর বৌদির স্নেহময় মুখের হাসি। ছোট কাকীমা =========== শেষ পঞ্চাশের টালীগঞ্জ। শীতের দুপুরে টালির চালে পড়েছে সেই বিশাল পেয়ারা গাছের ছায়া, পেছনের গল্ফ ক্লাবের সীমানায় ঝোপে ঢাকা নালা থেকে ডানা ঝাপ্টে পালালো এক ডাহুক, নারকেল গাছের ডালে বসে চোখ বুজে রোদ পোহাছে ভুষুন্ডি কাক। কঞ্চির বেড়ার ওপাশে পাশের বাড়ির উঠানে হুটোপুটি করছে কয়েকটি বাচ্চা। সাইকেলে চড়ে খেলনা বিক্রি করার হাঁক দিয়ে চলে গেলো একজন। এহেন কোনো এক অলস দুপুরে দরজার সামনের একফালি বারান্দায় চেয়ারে বসে এক পরিপাটি মহিলা পড়ছেন শরৎচন্দ্রের কোনো উপন্যাস -- ধবধবে সাদা শাড়ি কালো মোটাপাড়ের, চোখে কালো ফ্রামের চশমা, বাতাসে শুকানোর জন্য মাথার চুল খোলা, মুখে পান -- চারপাশের কোনো কিছুই তার মনোযোগ কেড়ে নিতে পারছে না। ইনি হলেন আমার ছোট কাকীমা, আমার আর এক কৈশোরের স্মৃতি। কাকীমা কানে শুনতে পেতেন না, কাকার মৃত্যুও অনেক রোগভোগের পর হয়েছিল, দেশভাগের অনিশ্চিয়তার ওপর নিয়মিত রোজগারের অভাব, সব মিলিয়ে, অনুমান করতে পারি, কাকীমা খুব আর্থিক অনটনে ছিলেন। কিন্তু তার মুখের হাসি ও রসিকতাবোধ বাকি সব অপারগতাকে ছাপিয়ে উঠতো যখন সে কথা বলতো। সেই টালীগঞ্জের ছবি এখন সময়ের ক্যানভাসে বিলকুল আলাদা। পেয়ারা গাছটি অনেক আগেই গেছে, টালীর চালের জায়গায় নিয়েছে আধুনিক পাকা বাড়ি, ডাহুক পলাতকা,প্লাস্টিকের খেলনাওয়ালাও আর আসে না। তবুও, উত্তরজীবনে যতবার গেছি ওই বাড়িতে, অনেক ছবির মতো সেই এলোকেশী ছোট কাকিমা ছবি খুঁজে বেড়িয়েছি -- মুখে পান নিয়ে চেয়ারে বসা,সাদা শাড়ী কালো পাড়, হাতে শরৎচন্দ্র।

Tuesday, February 22, 2022

গুজরাটের মেথীর গোটা

গুজরাটের মেথীর গোটা সর্দারগঞ্জ (আনন্দ, গুজরাট) কৃষি উৎপন্নের বড় পাইকারী বাজার। চাল ডাল গম তেল মশলা -- সব পাবেন এই বাজারে। আর আছে নানান অন্য ব্যবসায়ী -- কেউ বিদেশযাত্রার ব্যবস্থা করে দেবে, কেউ গাড়ির পার্টস বিক্রি করছে তো কেউ কাপড়, সোনার দোকান বা ইলেক্ট্রনিক্সের দোকান সাজিয়ে বসেছে -- নানান ব্যাঙ্ক ইন্স্যুরেন্স ইত্যাদি তো আছেই। চাকরী জীবনে এখান থেকে সারা বছরের রান্নার রশদ কিনতাম, উঁটগাড়িতে দোকানদার চাল ডাল তেলের টিন বাড়িতে পাঠিয়ে দিতো। সকাল আটটার আগেই দোকান সব খুলতে থাকে -- উঁট গাড়ি, সাইকেলভ্যান, অটো, নানান গাড়ির আওয়াজে ধীরে ধীরে জাগে গঞ্জ, একে একে সব দোকানের দরজা খুলে ঝাড়পোঁছ শুরু হয়। একটু পরেই সাইকেল মোটরবাইকে চড়ে আসবে কর্মচারীরদল, শহরতলি ও গ্রামাঞ্চল থেকে। চারদিক দোকান-অফিস ঘেরা ঠিক মোড়ের মাথায় মেথীর গোটা (বড়া) বিক্রি করার রাস্তার দোকানটা ততক্ষনে বিশাল লোহার কড়াইয়ে প্রায় লিটার দশেক বাদামতেল গ্যাস-চুল্লিতে বসিয়ে দিয়েছে, বাতাসে কাঁচা বাদামের গন্ধ বেরোতে শুরু হলো বলে, পাশেই এক কর্মচারী বড়ো এক বস্তা মেথী শাক জলে ধুয়ে চাকু দিয়ে কাটতে বসেছে, অন্যজন বেসনের বস্তা খুলে বিশাল এক ডেচকিতে ব্যাসন জলে গুলছে -- এর পরেই বেসনে মাখা মেথী ভাজা হবে ফুটন্ত তেলে। গোটার সাথে আপনাকে তেলে ডুবিয়ে ভাজা কাঁচা লঙ্কা দেবে, একদম ঝাল নেই, নির্ভয়ে চেবাতে পারবেন। যেই বড়ো লোহার ঝাঁঝরি হাতায় মেথীর গোটা তেল থেকে উঠিয়ে ঠন্ ঠন্ আওয়াজ করে তেল ঝরানো শুরু হলো, অমনি এতক্ষন ফাঁকা দোকানটি ঘিরে ফেললো আশেপাশের দোকান-অফিসে থেকে গুটিগুটি বেরিয়ে আসা নানা বয়েসী কর্মচারীরা -- সব কায়েমী খরিদ্দার, মুহুর্তে শেষ হয়ে যাবে প্রথমবারের সব ভাজা -- আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে আরও অনেকক্ষন। মেথীর গোটা গুজরাটি স্পেশালিটি স্ন্যাক, ভালো বেসন আর টাটকা বাদাম তেলে ভাজা (অন্য তেলও ব্যবহার হয় --সর্ষের তেল বাদে) মেথীর গোটা গুজরাটি ভোজনবিলাসীর প্রাতরাশের এক আবশ্যিক অঙ্গ -- সাথে ফাফডা জলেবী আচারআদি তো আছেই। সব দোকানের মেথীর গোটা যে সমান জনপ্রিয় তা না -- রসিকজন জানেন কোন দোকান থেকে কিনতে হবে। এমনিতে মোড়ের মাথায় বা হাইওয়েতে অনেক দোকানেই গোটা পাবেন কিন্ত আগের বানানো কিন্তু গরম করে দেওয়া মেথীর গোটা ভালো লাগবে না খেতে, বারবার এক তেলে ভাজলে বেসনের উজ্জ্বল রং টা কালছে হয়ে যায়, পছন্দ হবে না আপনার। আহমেদাবাদের বস্ত্রাপুর লেকে সক্কাল সক্কাল চলে আসুন, নানান প্রাতরাশের উপহার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গোটা ২০টা চারপেয়ে দোকান -- আপনার সামনেই বানিয়ে দিচ্ছে দক্ষিণী পশ্চিমী গুজরাটি খাবার, তার মধ্যে আছে উত্তম বেসনে বানানো মেথীর গোটা -- প্রাতঃভ্রমনাকারীদের অনেকেই সপরিবারে সকালের ভোজনটা এখানেই সেরে নেয়। হিম্মতনগর মোড় থেকে সোজা গেলে মাউন্টআবু, অন্য রাস্তা গেছে দিল্লির দিকে। মোড়ের মাথায় আছে অনেক ছোট ছোট খাবারের দোকান --পাবেন খুব ভালো মেথীর গোটা, যেকোনো সময় গেলেই তাজা বানিয়ে দেবে, মিনিট দশেকের অপেক্ষা। হালদিঘাট, যোধপুর। দেখি নীমগাছের ছায়ার নিচে একটা ভাজাভুজির দোকান -- গাড়ির নম্বর প্লেট দেখে যুবাবয়েসী দোকানদার খাতির করে বেঞ্চ পরিষ্কার করে বসার জায়গা করে দিলো। জিজ্ঞাসার উত্তরে যখন শুনলো আহমেদাবাদে থাকি, খুব খুশি -- এমনিতে আমাদের পড়শী মহল্লায় ওর আবাস, কিন্তু করোনার জন্য কাজ বন্ধ, তাই এখানে এসেছে এক আত্মীয়ের কাছে। শুধু শুধু বসে থাকবে, তাই এই দোকান। বানিয়ে দিলো গরম গরম মেথীর গোটা, ঠিক যেন বস্ত্রাপুরের স্বাদ, সাথে দিলো দই-বেসনের চাট, ঢেকী তুলে খাবার পর এলো বাদশাহী চা -- স্রেফ দুধে বানানো নানান মশলা দেওয়া চা। কখনো গুজরাট এলে মেথীর গোটা না খেয়ে যাবেন না, যেমন কলকাতা গেলে আমরা সিঙ্গারা কচুরীর আবেদন উপেক্ষা করতেই পারি না।

Saturday, October 9, 2021

সিঁথীর আরও গল্প – ফ্ল্যাশব্যাক: ১৯৫৫ / ১৯৬০

 

সিঁথীর আরও গল্প – ফ্ল্যাশব্যাক:  ১৯৫৫ / ১৯৬০

 


সিঁথীর মোড় 

জমজমাট সিঁথীর মোড়, সন ২০১৮, এক সকাল ১১টা। ট্রাফিকের লাল বাতি জ্বলতেই ব্রেক-চাকা-রাস্তার ঘর্ষণের চমকানো আওয়াজ তুলে যানবাহন থেমে গেলো সাদা লক্ষণরেখা ছুঁয়ে, রাস্তা পার হওয়ার জন্য জোয়ারের ঢেউয়ের মতো লোক আছড়ে পড়লো রাস্তায়, তার মিনিট খানেক বাদে বাতি নিভলেই ভীমরুলের চাকে যেন ঢিল পড়েছে, বাস ট্যাক্সি মোটর গাড়ী বাইক সব গর্জন করে চলা শুরু করলো।

সিঁথী যাবার রাস্তার ডান দিকে, মানে আগের এম.পি. ষ্টুডিওর উল্টাদিকে কয়েকটি দোকানের সারি, সামনেই একটা ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। (আগে ওখানে ছিল বিরাট পুরানো ভাঙা বাগানবাড়ী  (সিঁথীর মোড় থেকে কালীবাড়ি পর্যন্ত,এত বড় -- বিপরীতে ছিল আরো এক বাগানবাড়ী ও RBT স্কুল)। রাস্তায় ট্যাক্সি না পেয়ে গেলাম সেই স্ট্যান্ডে, একটা খালি ট্যাক্সি সেখানে ছিল। চারদিকে দেখি তৃণমূলের পতাকা টাঙানো, বসে-দাঁড়িয়ে আছে ৪-৫ জন "মুঝে পহেচানো" ভাবভঙ্গীর বাহুবলী। ড্রাইভার না দেখতে পেয়ে তাদের কাছে খোঁজ নিতে গেলে জিজ্ঞাসা করলো কোথায় যাবো আমি। এয়ারপোর্ট যাবো শুনে বললো "চারশো টাকা পড়বে"। বড়জোর ১৫০ টাকার দৌড়, আর ৪০০ টাকা ? বলাতে উপেক্ষার সুরে জানালো "যেতে হলে ওই ভাড়ায় রাজি হোন, নয়তো পথ দেখুন"। দেরী হয়ে গেছে, ইতিমধ্যেই মিনিট তিরিশ নষ্ট করেছি ট্যাক্সির খোঁজে, অগত্যা রাজি হতেই হলো ৪০০ টাকায়।

পঞ্চাশের দশকের শেষভাগে এই সিঁথীর মোড়ের দৃশ্য অন্য ছিল -- মানুষ, যানবাহনের ভীড়তো ছিলই না, কোনো ব্যস্ততাও নজরে পড়তো না।

কাশীনাথ দত্ত রোডের দুপাশে দেখুন। ষ্টুডিওর মুখে চায়ের আর মিষ্টির দোকানটা তখনও ছিল, সামনেই দোকানের ফেলা শালপাতা, মাটির ভাঁড় আর চা পাতা  থেকে জমে ওঠা  ছোট ঢিপি। উল্টা দিকে ছোট বট গাছ ঘিরে ছিল রিক্সা স্ট্যান্ড, লাগোয়া ছিল এক ভাঙাচোরা চায়ের দোকান, যেখানে রিকশাওয়ালারা রুটি-ঘুগনী খেতো দুপুরে-রাত্রে। এর পিছনেই ছিল এক পাঁচিলভাঙ্গা জনহীন বাগানবাড়ী, যার মাঠে ধোবীরা কাপড় শুকাতো। এই  বাগানবাড়ীর লাগোয়া ছিল কার্টার পুলার কোম্পানীর কর্মব্যস্ত কারখানা --সেই সাইকেল-টিফিনবক্স-কাঁধে ঝোলা- হাতে ছাতা নিয়ে শ্রমিকদের পথচলার দৃশ্য, যেমন হতো বেঙ্গল ইম্মুনিটির সামনে। উল্টাদিকের ষ্টুডিওর গল্প আগেই করেছি, অন্য এক প্রসঙ্গে।

বি.টি.রোডের উল্টাদিকে (মানে সিঁথী/ন'পাড়ার দিকে) ছিল টালির চালের কিছু দোকান ও বসত, বাস স্ট্যান্ড লাগোয়া রিক্সা স্ট্যান্ড। ওখানেই ছিল "স্বপ্নশ্রী" নামের এক যাত্রাদল -- প্রায় সন্ধ্যায় হ্যারিকেনের স্বল্প আলোয় রিহার্সাল হতো "গান্ধারী" পালার -- বলরাম আর কৃষ্ণ পরিকল্পনা করছে "কৌরবের শেষ চিহ্ন" মুছে ফেলার, সে কথা কানে যেতেই চোখে পট্টি বাঁধা দ্রৌপদী দুই ভাইয়ের সামনে এসে আহত অভিমানে বললো, "কৌরবের শেষ চিহ্ন আমি, তবে আমায় আগে হত্যা করো"।

মোড়ের মাথায় না ছিল কোনো স্ট্রিট লাইট, ট্রাফিক পুলিশ এসেছিল অনেক পরে। পদ্মজা নাইডু বছরে একবার ব্যারাকপুর গান্ধীঘাটে যেতেন, তখনি সিঁথির মোড়ে দেখা যেত কিছু পুলিশ।

সেই শেষ পঞ্চাশ দশকে সিথীর মোড়ে একটাই ট্রাফিক পুলিশ, বি টি রোডে নামমাত্র ট্রাফিক থাকায় বেশিরভাগ সময় সে আলস্যে হয় গাছের নিচে কিংবা চায়ের দোকানে বসে সময় কাটাতো। ওটা আমার স্কুল যাবার পথ। মাঝে মাঝে দেখতাম পুলিশ বাবু খুব সক্রিয় হয়ে উঠে রাস্তার গাড়ি-ঘোড়া সামলাচ্ছে, ঠিক চৌমাথায় দাঁড়িয়ে। হঠাৎ সে সব যানবাহন দাঁড় করিয়ে দিল, সবাই দেখলো সামনে দুটো মোটরবাইকে সাদা পোশাকের দুটো পুলিশ অফিসার মাঝখানে একটি কালো গাড়ি, আর তার পেছনে একটি পুলিশের গাড়ি। মাঝখানের মোটরগাড়িতে কে আছেন সেটা দেখার আগেই কনভয় দৌড়ে চলে গেল ব্যারাকপুরের দিকে। গাড়িতে ছিলেন রাজ্যপাল শ্রীমতি পদ্মজা নাইডু, প্রতিবছর এই রাস্তা দিয়েই যেতেন ব্যারাকপুর গান্ধীঘাটে, মহাত্মা গান্ধীকে প্রণাম জানাতে। কনভয় চলে যাবার দু মিনিট পরেই রাস্তা যানবাহন আবার স্বাভাবিক হয়ে যেত।

সন্ধ্যার পর মোড়ের বটগাছের নিচে ভূইঁফোড় একটা ছোট মন্দির, আর সেখানেই জমতো এক ছিলিম নেশার আড্ডা, ট্রাফিক পুলিশ ব্যবস্থা চালু হবার পর সে আড্ডা অনেক গোপনে চলতো। পুলিশ আসার পর শুরু হলো ডানলপের দিক থেকে আসা ট্রাক বা মালবাহী বাহনের ড্রাইভারদের থেকে টাকা তোলা -- পুলিশের ইঙ্গিতে একটা ছেলে হাত তুলে দৌড়ে যেত গাড়ির দিকে, ড্রাইভার বা ক্লিনার তার  হাতে বা দূর থেকে ছুঁড়ে দিতো টাকা/আধুলি। সেটা পকেটে পুরে সে পরে রাস্তার এক কোনে গিয়ে  পুলিশের সাথে হিসেবে নিকেশ করতো।

সময়ের সাথে সিঁথির মোড় তার চেহারা চরিত্র পাল্টেছে -- পাল্টায়নি শুধু ওই ষ্টুডিওর গেট ঘেঁষা চা আর মিষ্টির দোকান।

ফুটবল  ক্রিকেট  সাইকেল-প্রতিযোগিতা

সিঁথীর জনজীবনে অনেক বৈচিত্র্য ছিল. কালীতলার বাস স্ট্যান্ডের পাশে খোলা জমিতে ছিল এক পোড়ো ঘর, ইঁটের পাঁজরা বেরিয়ে এসেছে, তার দেয়ালের গায়ে মাথা ওঠাচ্ছে বটগাছ -- একটাই ঘর কিন্তু বেশ বড় মাপের। সেখানেই পাড়ার ছেলেরা বানালো তাদের ক্লাব "শিবনাথ স্মৃতি সংঘ"।

ভেতরে লাইট জ্বালিয়ে সন্ধ্যার পর বড় বুড়োরা তাস ক্যারাম খেলতো, সামনের ছোট জমিতে বানিয়ে ছিল বাহারি ফুলের বাগান -- শীতকালে সূর্যমুখী চন্দ্রমল্লিকারা রূপের হাট বসাতো। ওখানেই হতো পাড়ার সব সার্বজনীন পূজাগুলি। পাশেই ছিল বড় এক পুকুর, যার অর্ধেক ঢাকা থাকতো কচুরিপানা আর তার নীল ফুলে। তার লাগোয়া ছিল ফুটবলের মাঠ -- শিবনাথ স্মৃতি চ্যালেঞ্জ কাপ খেলতে ওই অঞ্চলের বাইরে অনেক দূর দূর থেকে টীম আসতো -- আন্দুল থেকে এসে কাপ জিতে নিয়ে যেত, বনগাঁ থেকে আসতো টীম, বেঙ্গল ইম্মুনিটির টীম খুব লোকপ্রিয় ছিল, বিশেষ করে তাদের ব্যবহার ও সততার জন্য। অনেক দর্শকের মধ্যে এক মাঝবয়েসী নিয়মিত ছিলেন, যার ছিল ফিট-এর ব্যামো। অনিবার্যভাবে  প্রায় সব ম্যাচেই লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই উৎসাহীর কপালে মাথায় বল এসে লাগবে, সে হাত-পা খিঁচিয়ে মাটিতে পরে যাবে, লোকেরা পাশের পুকুরের জল মাথায় ঢেলে তার সম্বিৎ ফেরাবে -- ওদিকে ম্যাচ চলতে থাকবে তার আপন গতিতে, ব্যাপারটা এমনই সামান্যতার পর্য্যায়ে পৌঁছেছিল। ওই মাঠেই ফুটবল খেলে অনেকে পরে কলকাতা লীগের প্রথম ডিভিশনের "ঐক্য সম্মেলনী" টিমে খেলেছে, পেয়ারাবাগানে ছিল সেই ক্লাবের ঘর।

শীতকালে এই মাঠেই টেনিস বলে ক্রিকেট খেলা হতো, বড়রা না থাকলে আমরাও পেয়ারা গাছের ডাল ভেঙে উইকেট বানিয়ে খেলতাম।

শিবনাথের একটা নামকরা বার্ষিক ইভেন্ট ছিল অবিরাম সাইকেল চালানো প্রতিযোগীতা, যে শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যাবে, সে পাবে একটা নতুন সাইকেলের পুরস্কার। রুটটা ঠিক মনে নেই, কিন্তু বৃত্তাকার রুট কালীতলা, ডি.গুপ্ত লেন, ফকির ঘোষ কলোনী আবছা মনে আছে. প্রতিযোগীদের সাইকেলে বসা অবস্থায় জল সরবত দেওয়া হতো, নামার উপায় নেই, স্বেচ্ছাসেবীদের নজর সজাগ। অনেক প্রতিযোগী অংশ নিত, খবরের কাগজের হকাররাতো খুব আশা নিয়ে নামতো -- শুরুতে প্রায় ৩০/৪০ জন প্রতিযোগী থাকতো, সন্ধ্যা বাড়লে কমে অর্ধেক, আর রাত্রিভোরে দেখাযেত বড়জোর ৫/৬ জন ক্লান্ত পায়ে টেনে চলেছে সাইকেল।  যারা পরের দিন সকাল পর্যন্ত টিঁকে থাকতো, তাদের গলায় লোকেরা টাকার মালা, ফুলের মালা পরিয়ে দিতো -- মোটামুটি দ্বিতীয় দিনের দুপুর পেরোতেই দেখা যেত বাকি সবাই থেমে গেছে, একমাত্র যে বহাল আছে, তাকেই বিজেতা বলে ঘোষণা করে মহা ধূমধামে তাকে নিয়ে শোভাযাত্রা বের হতো, আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে পুরস্কার দেওয়া হতো।

পাড়ায় ছিল এক ধোবি, শিবনাথের পেছনের পুকুরপাড়ে বড় মাটির উনুনে মাটির গামলায় কাপড় ফোটাতো সোডা সাবানের গরম জলে, কাঠের পাটাতনের ওপর মুখে চাপা আওয়াজ তুলে কাপড় আছড়াতো, পুকুরের জলে ধুয়ে লম্বা টাঙানো দড়িতে সেই কাপড় শুকাতো। পরে শুকনো কাপড় জামা ইস্তিরি করে সাইকেল নিয়ে বেরোতো ডেলিভারী দিতে। সেই ধোবি পর পর ২ বছর জিতেছিল সেই পুরস্কার -- পুরানো সাইকেল বেচে পুরস্কারের নতুন সাইকেলে চড়ে সে কাপড়ের পোটলা নিয়ে বেরোতো, এখন তার সাইকেলে পুরো চেইন-কভার আছে, ভালো স্প্রিংএর ঘন্টা আছে,ব্যাটারীর লাইট আছে, আছে চওড়া ক্যারিয়ার।

(রানী রাসমণির বাগানবাড়ীর পুকুরেই কালীতলা-ফকিরঘোষ কলোনীর সবাই সাঁতার শিখতো, বড়োরা বাঁধানো ঘাটের উঁচু চাতাল থেকে লাফ মারতো, এপার ওপার করতো। এক বোরো দুর্ঘটনায় এখানেই জলে ডুবে মারা যায় ফকিরঘোষ কলোনির এক তরুণ -- সে এক বড় দুঃক্ষজনক ঘটনা। এখন আর নেই সেই শিবনাথের মাঠ, আম সুপারি পেয়ারা নারকেল গাছ ঘেরা বাগানবাড়ি, নেই সেই ছায়াঘেরা পুকুর -- সব এখন বাড়িঘরে ভরা) ।

নেতাজীর জন্মদিন -- পহেলা বৈশাখ 

প্রতি বছর নেতাজীর জন্মদিনে সিঁথীতে প্রভাতফেরী হতো। প্রায় ২০ ফুট উঁচু পরিচিত যুদ্ধবেশে সজ্জিত নেতাজীর এক বিশাল মাটির মূর্তি ট্রাকে করে নিয়ে সুন্দর সুশৃঙ্খল শোভাযাত্রা বের হতো। গাড়ীর আগে থাকতো ছোটদের ব্যান্ড-কুচকাওয়াজের দল -- সাদা জামাকাপড়, কোমরে বেল্ট, সাদা জুতা, মাথার কালো টুপীর ওপর রঙিন পালক -- কারোর হাতে ব্যান্ড, কারোর হাতে বাঁশী -- সব চাইতে সামনের ছেলেটার হাতে একটা ছড়ি -- চলেছে গান গাইতে গাইতে "উর্ধ্বগগনে  বাজে মাদল"। নেতাজীর তেজভরা দীপ্ত মুখ দেখে কিশোরে মন বলতো, আমি থাকলে ছুটে যেতাম ইম্ফলে, দিল্লীর যাত্রা অবশ্যই শেষ করতাম। পহেলা বৈশাখেও প্রভাতফেরী হতো, মাইক্রোফোন লাগিয়ে অল্প বয়েসী উজ্জ্বল মেয়েরা লালপেড়ে সাদাশাড়ী পড়ে ট্রাকের ওপর বসে-দাঁড়িয়ে তাদের লম্বা বিনুনী দুলিয়ে গান গাইতো,"এসো হে বৈশাখ এসো এসো"। আর পূজার পর পাড়ায় পাড়ায় হতো বিজয়া সম্মেলনী, গান বাজনা নাটক আবৃত্তিতে ভোরে উঠতো সন্ধ্যাগুলো। কোথায় গেলো সে  সামূহিক আনন্দউৎসবের দিনগুলি!

ভোটের কড়চা

ভোটের ঢাকে কাটি পড়তেই সিঁথি-বরানগরে সাজো সাজো রব উঠতো। দেয়ালে ছাপানো পোস্টার আটা-ময়দার আঠা দিয়ে লাগাও, রঙীন চিত্রকারী করো দেয়ালে পাঁচিলে, দলের প্রতীক এঁকে ও প্রার্থীর নাম লিখে। ষাটের শুরুতে তার সাথে যুক্ত হলো স্লোগান লেখা, তথ্য দিয়ে প্রতিপক্ষকে কাবু করা, ব্যঙ্গ চিত্র আঁকা ইত্যাদি। পার্টি অফিসে যাও, দেখবে মাটিতে বসে সমর্থকেরা একের পর এক পোস্টার লিখছে, চায়ের দোকান থেকে মাঝে মাঝে আসছে মাটির ভাঁড়ে চা, চা শেষে সেই ভাঁড়কেই ছাইদান বানানো হতো, বিড়ি চারমিনারের ধুঁযায় ঘর ভরে যেত।

রাত্রেই হতো পোস্টার ব্যানারের কাজ, দিনে হতো শোভাযাত্রা মিটিং পথসভা গণসংযোগ। নির্বাচন বিশেষে ওদিকে সুশীল পাল, এদিকে গণপতি সুর, ডানলপের ওপরে রাধিকা ব্যানার্জী, টালার ওপারে লক্ষী সেনরা সক্রিয় হয়ে উঠতো সমর্থকদের সাথে।

পাড়ায় পাড়ায় ঘরে ঘরে গিয়ে ভোটদাতাদের সাথে প্রত্যক্ষ গণসংযোগ রাখা পঞ্চাশের দশকে খুব সাধারণ ঘটনা ছিল। প্রার্থী তার দলবল নিয়ে হেঁটে বা সাইকেল চড়ে ছোট ছোট শোভাযাত্রা নিয়ে ঘুরতেন, হাত জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে ভোট ভিক্ষা করতেন -- জোড়া-বলদ কিংবা কাস্তে-ধানের-শীষ আঁকা দলীয় পতাকা নিয়ে।

কালীতলার বাঙালবাড়ীতে অনেক ভোট, সবাই জানতো। কর্পোরেশনের নির্বাচনে গণপতি সুর বাঁধা প্রার্থী ছিলেন কংগ্রেসের  এবং জয়ীও হতেন। লাভ নেই জেনেও উনি বাঙালবাড়ীতে আসতেন, সবার সাথে হাসিমুখে শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন, হাত মেলাতেন। ওপারের কাশীপুরে কংগ্রেস প্রার্থী  সুশীল পাল অনেক ভোট জিততেন, এপারের গণপতি সুরের মতোই। কিন্তু চট্টগ্রাম মামলার সাথে জড়িত বিপ্লবী গনেশ ঘোষ বিধানসভার নির্বাচনে কমিউনিস্ট প্রার্থী হয়ে দাঁড়াতেই সিঁথীর রাজনৈতিক সমীকরণ পাল্টে গিয়েছিলো, বামপন্থীদের প্রভাব ধীরে ধীরে বেড়েছিল।

সংসদীয় গণতন্ত্রের শুরুর দিকে নির্বাচন নিয়ে নোংরামী বদমায়েশী বা হাতাহাতির রেষারেষি হতো না, কে কাকে ভোট দেয় সেটা মোটামুটি সবার জানা থাকতো। কিন্তু ভোটের পর তেমন তিক্ততা থাকতো না। বাঙালবাড়ীর লোকেরা রেশন কার্ড বা ইলেকট্রিক কানেক্শনের ব্যাপারে যখনই সুপারিশের জন্য গেছে ওনার বাড়ীতে, গণপতি সুর বিনা প্রশ্নে আবেদনপত্রে সুপারিশ করে দিতেন।

Wednesday, September 22, 2021

এই তো সেদিন

 এই তো সেদিন 


বাঁধের পশ্চিমে তখন সূর্য ঢলো ঢলো. পায়ের খুরে বাঁধের মাটি উড়িয়ে বাথানে ফিরছে গরুর পাল, তাদের পিছনে বারো'মাইলের হাট থেকে মাথায় পোটলা নিয়ে ফিরছে কয়েকজন। পাশের কাদুয়া'দির কঞ্চির বেড়াতে ঝিঙ্গার লতায় হলুদ ফুলের পসরা,  ভোমরারদল তাদের শেষ মধুটুকুও শুষে নিয়ে গেছে। এখন আমার পড়তে যাবার সময়, প্রায় আধ মাইল দূরে, মোক্ষদা'র কাছে। মোক্ষদা একা থাকে তার তালপাতা দিয়ে বানানো এক চালের মাটির ঘরে। প্রায় সত্তরের কাছাকাছি সে, সামান্য ঝুঁকে চলে, মাথায় সাদা চুল, ফর্সা মুখে কপালে বয়েসের ভাঁজ। গ্রামের লোকের দয়াতেই সে বেঁচে আছে। দিনের বেলায় তাকে দেখেছি আমার মা'র কাছেও আসতে, সাদা কাপড়ের খুঁটে বেঁধে নিয়ে যেত চাল বা আনাজ। মোক্ষদা স্বাক্ষর ছিল, তাই মা তার কাছেই পাঠাত আমার বর্ণ পরিচিতির জন্য। প্রায় ওড়িষ্যা ঘেঁষা বলে বাংলা না, ওড়িয়াতে ছিল মোক্ষদার প্রাথমিক শিক্ষা, আর আমাকেও সে ওড়িয়াতেই অ আ শেখাতো।
হাতে স্লেট-পেন্সিল নিয়ে বাঁধের রাস্তা ধরে সন্ধ্যায় হেঁটে যাওয়া উঠতি পড়ুয়ার। ওপারের প্রান্তজুড়ে পড়ে থাকা ধানের ক্ষেত, ক্যানালে বাঁশের নোঙ্গরে বাঁধা ডিঙি নৌকা, ঘুঁটের ধোঁয়ার আস্তরণে আস্তে আস্তে ভারী হচ্ছে চারপাশ, বেঁটে নীমগাছের গোড়ায় কেউ জ্বালিয়ে গেছে প্রদীপ। বিশাল বটের কাছে যেতেই ওপরে পাখীদের চেঁচামিচি, নিচের মাটির চাতালে গল্প গুজব শেষ করে বুড়োরা যে যার ঘরে ফিরে যাবার পথে।
তালপাতার চাটাইয়ে বসে স্লেটে মোক্ষদার লেখা অ আ'র ওপর হাত বোলাচ্ছি, পাশে মাটির ঊনানে মাটির সানকিতে গরম বালীতে মুড়ী বানাচ্ছে মোক্ষদা, বাঁশের চোঙ্গায় ফুঁ দিয়ে আগুনের আঁচ বাড়াচ্ছে মাঝে মাঝে। ঘুঁটের আগুনের আঁচে থেকে থেকে খুব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে তার মুখে কপালে সময়ের দাগগুলো। দারিদ্র বা আপন-পর বোঝার বয়েস ছিল না সেই আমার, কিন্তু মোক্ষদাকে আমার খুব ভালো লাগতো, ভালো  লাগতো সে যখন ময়লা স্লেট ময়লা মুছে আবার নতুন করে হরফ লিখে দিতো, ভালো লাগতো যখন সে কাপড়ে মুখ মুছতে মুছতে এগিয়ে দিতো আমার দিকে গরম মুড়ির বাটী বা আমার  থুতনীতে হাত দিয়ে স্নেহ প্রকাশ করতো।।
প্রায় এক ঘন্টার পর বাড়ি ফেরার সময়। ততক্ষনে বিশাল বটগাছে পাখীর চেঁচামেচী শেষ, কেবল থেকে থেকে বাদুড়ের পাখার ঝাপ্টার শব্দ। ফণীমনসার ঝোপে কোন সরীসৃপের আসা-যাওয়া, কার আঙিনায় বিশ্রাম নিচ্ছে সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে ধান ভাঙার ঢেঁকি, আঁধারে ঢেকে গেছে ও পাড়ের ধানের ক্ষেত, কাদুয়া'দির ঝিঙার বেড়ায় তখন অজস্র জোনাকীর আনাগোনা।
রাতে মায়ের পাশে শুয়ে ঘুম ভেঙে গেলে অন্ধকারে মা'র মুখ দেখে ভাবতাম, আমার মা'র মুখে কপালেও  কি একদিন ভাঁজ পরবে, ঝুঁকে চলবে ? আর সেই সাথে এক প্রশ্ন, মোক্ষদা কেন একা থাকে, আমাদের সাথেও তো থাকতে পারে!
এখন আমিও স্বাক্ষর কিন্তু ছোটবেলার সব প্রশ্নের উত্তর এখনো পেলাম না।