হেমন্তবাবুর
গল্প
যখন
বরানগর নরেন্দ্রনাথ বিদ্যামন্দিরে ক্লাস ৫/৬-এ
পড়ি (১৯৫৭/৫৮), তখন
বিদায়- অনুষ্ঠান হলো স্কুল ফাইনাল
যারা দেবেন, সেই উঁচু ক্লাসের
দাদাদের জন্য। বিদায়ী দাদাদের সাথে
বসে ছিলেন একজন যিনি সরস্বতী
পূজায় আবৃত্তি করে শোনাতেন আমাদের
-- অন্যদের থেকে একটু বেশিই
লম্বা, মাথায় ঘন চুল, মোটা
পাওয়ারের কালো ফ্রেমের চশমা,
মুখে তরুণ দাড়ি। ভুলেই
গেছিলাম, কথা প্রসঙ্গে কিছুদিন
আগে সেই ছোটবেলার বন্ধু
ও সহপাঠী শ্রী মিলন দাশ
মনে করিয়ে দিলো, সেই দাদাই ছিলেন
পরবর্তী জীবনের নামকরা আবৃত্তিকার শ্রী প্রদীপ ঘোষ।
নিচের ঘটনাটা
এক টিভি সাক্ষাৎকারে শোনা।
প্রদীপ ছিলেন
হেমন্ত বাবুর ভক্ত, কিন্তু কোনদিনই সামনা সামনি দেখা বা কথা হয়নি। একবার কোনো এক অনুষ্ঠানে
গিয়ে দেখেন হেমন্তবাবু বসে আছেন স্টেজের পাশের একটা ঘরে। খুশী ঢাকতে পারলেন না প্রদীপ,
ঢপ করে পায়ে হাত দিয়ে নমস্কার করতে গিয়ে বললেন, "হেমন্ত'দা" (পাশে বসা এক বর্ষীয়ান ভারী গলায় বললেন,
"দাদা না, কাকু বলো") "আমি আপনার গান খুব পছন্দ করি"। প্রদীপ নিজের
পরিচয় দিতেই হেমন্তবাবু বললেন, "তোমার নাম আমি শুনেছি, তুমি নাকি ভালো আবৃত্তি
করো, একদিন আমার বাড়িতে এসে আমাকে আবৃত্তি শোনালে খুব খুশী হবো"। হেমন্তবাবুর
দেওয়া কার্ডে টেলিফোন নম্বর দেখে ওনার সহকারীর সাথে কথা বলে এক নির্দিষ্ট দিনে হেমন্তবাবুর
বাড়িতে উপস্থিত হলেন প্রদীপ।
বৈঠকঘরে ওনাকে বসালেন একজন, অপেক্ষা করার জন্য। একটু
পরেই আসলেন হেমন্তজায়া, অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, "উনি
জরুরী কাজে বাইরে গেছেন,
আপনি আসবেন আর উনি নেই
এ কথা ভেবে খেদপ্রকাশ
করে বলেছেন আপনি যেন কিছু
না মনে করেন, অন্য
কোনোদিন নিশ্চই আপনাকে আমন্ত্রণ করে আপনার আবৃত্তি
শুনবেন উনি -- আর আপনাকে দেবার
জন্য এই প্যাকেটটা রেখে
গেছেন "। বাড়ি এসে
প্যাকেটটা খুলে দেখেন হেমন্তবাবুর
লেখা আক্ষেপ-চিঠি আর উপহার
হিসেবে গোটা দশেক ওনার
গানের রেকর্ড"।
স্কটিশচার্চ
কলেজের ছাত্রদের বার্ষিক অনুষ্টান মহাজাতি সদনে, ১৯৬৬/৬৭-এ। আহামরি কোনো বাজেট হতো
না, কিন্তু নামকরা বাঙালি শিল্পীরা প্রায় সবাই এইসব কলেজ অনুষ্ঠানে এসে গান গাইতেন
সামান্য পারিতোষকে, নিজে সেই কলেজের প্রাক্তনী হলে তো এমনিতেই গাইতেন। স্কটিশের অনুষ্টানে
অনেকের মধ্যে ছিলেন চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় (অতি সুদর্শন, নীল পাঞ্জাবী,সাদা পাজামা
-- আরো কিছুর সাথে গেয়েছিলেন "প্রমোদে
ঢালিয়া দিনু মন" আর "সেদিন দুজনে"), ওনার পরেই আসলেন হেমন্তবাবু। ততদিনে
বোম্বের ছায়াছবির জগতে সুরকার ও শিল্পী হিসেবে ওনার প্রতিষ্ঠা খুব মজবুত, সাদা ধুতি-পাঞ্জাবী
আর গায়ে হালকা হলুদ রঙের চাদর। সুযোগ বুঝে আমি একটা কাগজের টুকরোয় ৩ টা গানের অনুরোধ করলাম লিখে -- খুলে পড়লেন কাগজের সেই
চিরকুট, আর মাইকে বললেন, "গাঁয়ের বধূ" একদম শেষে গাইবো, কেমন ?"
সিঁথীর মোড়ের
চায়ের দোকানে গাড়ি থামিয়ে চা সিগারেট খেয়েছেন ছায়াছবি ও গানের জগতের অনেক নামকরা শিল্পী,
আমরা ছেলে-ছোকরাদের সাথে চোখাচুখী হলে দেখে
ওনারা অনেকেই মুচকি হাসতেন। সাফল্য সে যুগে শিল্পীদের আচরণে প্রভাব ফেলত না, পা মাটিতেই
থাকত।