সবিতা চৌধুরী স্মরণে
গত এপ্রিলের মাঝামাঝি কলকাতায় গিয়েছিলাম, অন্য কাজের সাথে আপনার সাথে দেখা করার কথা ছিল, কিছু প্রশ্নোত্তর আলাপের জন্য, আপনিই আসতে বলেছিলেন। কিন্তু কলকাতায় গিয়ে যখন না আপনার মোবাইল, না আপনার ল্যান্ডলাইন যখন সাড়া দেয়নি অনেক দিন অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও, সংশয়ের দানা তখনি মনে বেঁধেছিলো। ফিরে এসেও অনেক চেষ্টার সেই এক ফল। গত মাসের মাঝামাঝি টেলিফোনে আপনার পরিবারের এক সদস্যা জানালেন আপনার অসুস্থতার কথা, দিন দশেক আগেও খোঁজ নিয়েছিলাম, বাড়িতেই চিকিৎসা হচ্ছে জেনেছিলাম। রোগ জানিয়ে শরীরে বাসা বাঁধে না। ২০১৫- তে আপনাকে সুস্বাস্থেই দেখেছিলাম (ওপরের ছবিটা তুলেছিলাম ২০১৫-এ, আপনার বাড়িতে) -- বলেছিলেন পাকিস্তান থেকে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পদস্থ আধিকারিক আপনার বাবার ভারতে আসা, বম্বের নানান সংগীত পরিচালকদের সাথে আপনার গান করার অভিজ্ঞতা, সলিলবাবুর সাথে প্রথম পরিচয়ের কথা, বাংলাদেশের সাথে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ, আরও অনেক ব্যক্তিগত কথা -- নিজের একটা সি.ডি ("গুন্ গুন্ গুন্ সারাদিন") উপহার দিয়েছিলেন, সারাজীবন যেটা যত্নে রাখবো। পরে টেলিফোন অনেকদিন কথা হয়েছে, আপনার ওপর আমার ব্লগ লেখার ইচ্ছা আছে শুনে খুশি হয়েছিলেন, সেই জন্যই গতবার কলকাতায় গিয়ে আপনার সাথে যোগযোগ করার (বৃথা) চেষ্টা। আজ সকালে টিভিতে আপনার তিরোধানের কথা শুনলাম।
আপনি আমার প্রিয় শিল্পীদের মধ্যে একজন ছিলেন, অমন স্বাচ্ছন্দে, তারুণ্যের উচ্ছাসে খুব কম শিল্পী আধুনিক বাংলা গান গেয়েছেন। শোক প্রকাশের কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না -- আপনার আত্মার শান্তি কামনা করি, যেখানেই থাকুন, ভালো থাকবেন।
(আপনার ওপর ব্লগের প্রাথমিক খসড়া আগেই করে রেখেছিলাম, আপনাকে দেখানোর জন্য (তার সাথে ছিল আপনার জন্য এক রাশ প্রশ্ন), সেটা আর চূড়ান্ত করা গেলো না, কি আক্ষেপ ! নীচে সেই অসম্পূর্ণ খসড়া তুলে দিলাম পাঠকদের জন্য)।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
অসম্পূর্ন লেখা:
পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে বোম্বের এক বাঙালী গায়িকা আলোড়ন তুলে ঢুকে পড়লেন বাংলা গানের জগতে। চঞ্চল তারুণ্যে ভরা সপ্রতিভ সেই গায়িকা ছিলেন এক
সবিতা ব্যানার্জী, পরবর্তী জীবনে যাকে আমরা শ্রী সলিল চৌধুরীর সহধর্মিনী সবিতা চৌধুরী নামেই
জানি। কিন্তু সবিতার গানের জগতের শুরু অনেক আগেই হয়েছিল, হিন্দী ছায়াছবির জগতে, সেই মধ্যে-পঞ্চাশের দশকে।
মহম্মদ রফি,আশা ভোঁসলে, মহেন্দ্র কাপুর যেমন প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের সাথে গেয়েছেন দ্বৈতসঙ্গীত (গর্মা গর্ম-১৯৫৭, ললকার-১৯৫৬, লুটেরা-১৯৫৫), অন্ততঃ ছয়টি হিন্দী ছায়াছবিতে একক সংগীত গেয়েছেন, (এয় দিল, বাগী সর্দার, সুলতান-এ-আলম, ইহুদি-কী-বেটী-১৯৫৬, আফ্রিকা ও দরওয়াজা-১৯৫৪), সলিলবাবু জীবনে আসার আগেই। পরে আরও গেয়েছেন, যতটা না সলিলবাবুর সুর দেওয়া হিন্দি ছায়াছবিতে তার থেকেও
বেশি অন্যদের ছবিতে, বিশেষ করে এককভাবে।সবিতা তার জীবনে সাকুল্যে প্রায় চল্লিশটি হিন্দি ছায়াছবিতে গান গেয়েছেন একক, দ্বৈত বা সমবেত কণ্ঠে।আর
যাদের সুরে সেই সব গান গেয়েছেন তারা সবাই যশস্বী সুরকার ছিলেন -- এস.ডি.নাসাদ, সি.রামচন্দ্র, রবীন চ্যাটার্জী, বিনোদ, বি.এন.বালী, কমল মিত্র, ধনীরাম, এস.এন.ত্রিপাঠী, রবীন ব্যানার্জী -- যোগ্যতা না থাকলে এমন সব সুরকারদের সাথে কাজ
করার সুযোগ পাওয়া যেত না। অর্থাৎ,
সবিতার শিল্পী জীবন কেবলই যে সলিল-নির্ভর ছিল তা না, তার বাইরেও স্বীকৃতি পেয়েছিল, আগেই ।(প্রসঙ্গত, সলিলবাবু'র সুরে, হিন্দী ছাড়াও, সবিতা অনেক গান গেয়েছেন মালয়ালম, কান্নাডা, তামিল, অহমিয়া ও ওড়িয়া ভাষায়)।
ওপরের আলোচনার এই জন্য প্রয়োজন ছিল কেননা শিল্পী সবিতাকে নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয় নি সংবাদ মাধ্যমে, যা আছে তা স্বল্প ও অনুষাঙ্গিক নিয়ে, কিছু মূল্যায়ন অকারণে সংবেদনহীন,কখনো বা বিরক্তিকরভাবে শিল্পীর ব্যক্তিগত জীবন ছোঁয়া। ভালো সুরকারের হাতে পরেই সুনাম অর্জন করেছেন সব শিল্পী। সলিলবাবুর সংসর্গে সবিতার গায়কী অবশ্যই অনেক পরিণত হয়েছে -- এক গন্ডা গানের উল্লেখ করা
যায় সেটা সলিলবাবু অন্য শিল্পী কে দিয়ে গাইয়েছেন, যেগুলো সবিতা সমান
স্বাচ্ছন্দে ও প্রভাবে গাইতে পারতেন।
শ্রোতাদের কিন্তু একটা জিজ্ঞাসা থেকেই যায় -- এত সুন্দর সুন্দর সব বাংলা
গান গেয়েছেন কিন্তু বাইরে অন্য সুরকারদের সুরে গাওয়া গানের সংখ্যা এত কম কেন ? শুরুতে নচিকেতা ঘোষের দুটি গানের পর শ্রী সুধীন দাশগুপ্তর
সুরে "পঙ্কতিলক" (১৯৬১) ও "তাহলে" (১৯৬৪) ছায়াছবিতে গেয়েছিলেন। আর সুধীনবাবুর সুরেই গেয়েছিলেন সেই জনপ্রিয় গান "ও পথে যাব না যাব না কুসুম
ছড়াবো না" (১৯৬৪) -- এর বাইরে যা গেয়েছেন বাংলা গান, তা সবই সলিলবাবুর সুরে।
No comments:
Post a Comment