Saturday, February 27, 2016

স্বর্ণযুগের সুরকার শ্রী কানু ঘোষ

স্বর্ণযুগের সুরকার শ্রী কানু ঘোষ

শ্রী কানুরঞ্জন ঘোষ (১৯২৩-১৯৯৭)স্বর্ণযুগের এক কুশলী সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন, ভারতীয় গণনাট্য সংঘের এক সক্রিয় সদস্য ছিলেন। চল্লিশের দশকের শেষের দিকের কথা -- আধুনিক বাংলা গানের আসর জমাট করে রয়েছেন শৈলেশ দত্তগুপ্ত,কমল দাশগুপ্ত, অনুপম ঘটক, সুধীরলাল চক্রবর্তী, রবিন চট্টোপাধ্যায়, নির্মল ভট্টাচার্যদুর্গা সেন শ্রেনীর সব প্রতিষ্ঠিত সুরকার। সেই আসরে জায়গা পাওয়া খুব কঠিন ছিল, যদি না কেউ অতি প্রতিভাবান হতেন। সেই সময়েই সুরকারদের এক নতুন ফসল উঠেছিল, পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে যারা পুর্বসূরিদের বানানো  আধুনিক বাংলা গানের ভিতের ওপর নতুন শৈলী স্থাপনা করেছিলেন। পরেশ ধর, সলিল চৌধুরী, সুধীন দাশগুপ্তরা ছিলেন সেই নতুন সুরকারদের মধ্যে যারা গণনাট্য সংঘের পতাকা হাতে নিয়েছিলেন, বিশিষ্টতার স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।  স্বকীয়তায় প্রত্যেকেই উজ্জল ছিলেন, সংঘের পরিবেশে সবাই বেড়েছেন, কেউ  ছিলেন সুরকার, কে গীতিকার, কেউ দুটোই  - -  কানুবাবু ছিলেন শেষের দলে প্রায় তিন দশক ধরে উনি আধুনিক বাংলা এবং অন্য প্রাদেশিক ভাষার গানের অগ্রগতিতে যোগদান করেছেন, বিভিন্ন ভূমিকায়। দুঃখের কথা, বিশেষ কিছু জানা যায় নি কানুবাবুর জীবনের, এই লেখা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তথ্যগুলো এক জায়গায় করা ছাড়া অভিনব কিছু করেনি, স্বীকার করে নিলাম

কানুবাবুর আধুনিক বাংলা গান

যদিও কানুবাবু সলিল চৌধুরীর সঙ্গীত-সহকারী হিসেবে অনেক কাজ করেছেন, নিজেও অনেক স্মরণীয় সুর দিয়েছেন, যা এখনো শ্রোতাদের কানে ভাসে। লভ্য তথ্য অনুযায়ী, ওনার সুরে প্রথম গান ১৯৫১ এ প্রকাশিত হয়, তারপর থেকেই তালাত মাহমুদ ও গীতা দত্তর অনেক গানের সুর দিয়েছেন, যা এখনো আমরা শুনি।ষাটের দশকে আকাশবাণীর "অনুরোধের আসর"আর কানুবাবুর সুর দেওয়া কোন গান শোনানো হয়নি, এমনটা কমই '

গীতিকার কানুবাবুর লেখা গানে মুকুল দত্তর  সুরে গীতা দত্ত গেয়েছেন "সীতার দুঃখের  কথা" (১৯৫২) আর সুধীন দাশগুপ্তর সুরে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য গেয়েছেন "গান গেয়ে ফিরে গেছি" -- দুটি অপূর্ব গান, সুর বাণীতে সমৃদ্ধ।

কানুবাবু ও ভারতীয় গণনাট্য সংঘ

স্থাপনার শুরু থেকেই গণনাট্য সংঘ, মুম্বাইয়ের একটা বিশেষ অঙ্গ ছিল musical choir, সেই ১৯৪২-৪৩ থেকে। জাতীয়তাবাদী গান, গণজাগরণের গান, সাধারণ লোকেদের লেখা গান ছিল সংগ্রামী, মেহনতী  মানুষদের একত্রিত করার উপায়।সংঘ মোটামুটি সারা ভারতে এমন musical choir-এর সমূহ সংগঠিত করেছিল যারা নিয়মিত ভাবে গান-নাটকের অনুষ্টান, ধর্ণা, প্রতিবাদ সভা ইত্যাদি উপলক্ষ্যে choir-এর গান গাইত। সময় এগোবার সাথে সাথে রবি শংকর, কানু ঘোষ, সলিল চৌধুরী, প্রেম ধাওয়ানেরা যুক্ত হন সেই আন্দোলনে। কানুবাবু  ও সলিল চৌধুরী নিয়মিত ভাবে হাজির থাকতেন Bombay University  এবং IIT-Bombay- music choir- কানুবাবু Bombay University-তে music choir সঞ্চালনা করেছিলেন, যেমন করতেন আকাশবাণী' radio choir group-এর সঞ্চালন। অনেক সাম্যবাদী লেখক বিদ্দজ্জনদের মতো কানুবাবুও মিলমজুরদের "আওয়ামী ইদারা" নামের পুস্তকাগার-ও-সাংস্কৃতিক মঞ্চের জমায়েতে যেতেন -- তখন মধ্য বম্বের মমিনপুরা, মদনপুরা, কালাপানি ও সঙ্কলি স্ট্রীট ছিল মুসলমান মিল শ্রমিকদের অঞ্চল। কানুবাবুর জাগরণ ও প্রতিরোধের গানগুলির মধ্যে জনপ্রিয় ছিল "আমান কে সিপাহী মেরা দেশ", "ইস বার লড়াই লানে বালা" "এ জং, জং নেহি"(গানগুলো ছিল গীতিকার শৈলেন্দ্র' লেখা), সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ও কানুবাবুর সুরে গেয়েছেন "ও রে জীনেবালে"(প্রেম ধাওয়ান'এর লেখা) দু'একটি বাংলা হিন্দী নাটকেও কানুবাবু গানের সুর দিয়েছিলেন।



"ইদারা"তে বামপন্থী বিদ্দজনদের  সমাবেশ: 




http://www.harmonyindia.org/images/Red-song2.jpg




(বাঁ দিক থেকে): 
কানু ঘোষ, মজরুহ সুলতানপুরি, স্যামুয়েল অগাসটাইন, বিশ্বনাথ আদিল, কে.এ.আব্বাস  
                                              The 1960 Music choir with Kanu Ghosh at the harmonium.
                                     ১৯৬০-এর music choir - - কানুবাবু হারমোনিয়াম বাজাতেন। 



শ্রী কানু ঘোষের সুর দেওয়া গান
গান
শিল্পী
গীতিকার
সন
রূপের ওই প্রদীপ জ্বেলে
তালাত মাহমুদ
শ্যামল গুপ্ত
১৯৫১
মুখর বাদল দিনে
তালাত মাহমুদ
প্রভাত বসু
১৯৫১
পদ্মা আমার কহে কেঁদে
গীতা দত্ত
কানু ঘোষ
১৯৫৩
রুমঝুম ঝরনার
গীতা দত্ত
অনল চট্টোপাধ্যায়
১৯৫৭
তোমায় দেখেছি তন্দ্রাবিহীন
গীতা দত্ত
অনল চট্টোপাধ্যায়
১৯৫৭
আয়ে রে আয়ে রে ছুটে
গীতা দত্ত + অন্যরা
কানু ঘোষ
১৯৫৮
সে কোন সাওনী মেঘ
তালাত মাহমুদ
শ্যামল গুপ্ত
১৯৫৯
ওই সুর ভরা দূর নীলিমায়
গীতা দত্ত
অনল চট্টোপাধ্যায়
১৯৫৯
এই তো বেশ এই নদীর তীরে বসে
তালাত মাহমুদ
শ্যামল গুপ্ত
১৯৫৯
আকাশজুড়ে স্বপ্নমায়া
গীতা দত্ত
অনল চট্টোপাধ্যায়
১৯৫৯
ওগো আমার মনের চির উদাস
গীতা দত্ত
শ্যামল গুপ্ত
১৯৬০
কথা আছে তুমি আজ আসবে
গীতা দত্ত
শ্যামল গুপ্ত
১৯৬০
যে আঁখিতে এত হাসি লুকানো
তালাত মাহমুদ
শ্যামল গুপ্ত
১৯৬১
তোমার আশায় পথ চেয়ে
গীতা দত্ত
পুলক বন্দোপাধ্যায়
১৯৬৪
কবে কোন তারা জ্বালা রাতে
গীতা দত্ত
পুলক বন্দোপাধ্যায়
১৯৬৪
রঙের বাসরে
সুমন কল্যানপুর
মুকুল দত্ত
১৯৬৫
এই চন্দ্রমল্লিকাকে
সুমন কল্যানপুর
মুকুল দত্ত
১৯৬৫
বউ কথা কও গায় যে পাখি
তালাত মাহমুদ
পুলক বন্দোপাধ্যায়
১৯৬৬
অনেক সন্ধ্যাতারা ফোটে
তালাত মাহমুদ
পুলক বন্দোপাধ্যায়
১৯৬৬
সোনায় ঢেকে অঙ্গ
গীতা দত্ত
সলিল চৌধুরী
১৯৬৭
যাক না মুছে যাক
গীতা দত্ত
সলিল চৌধুরী
১৯৬৭
ও ভাই রে
মান্না দে
সলিল চৌধুরী
১৯৭২
সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর
মান্না দে
সলিল চৌধুরী
১৯৭২
তুমি এস, ফিরে এস
তালাত মাহমুদ
পুলক বন্দোপাধ্যায়
১৯৭৩
দেখি নতুন নতুন দেশ
তালাত মাহমুদ
পুলক বন্দোপাধ্যায়
১৯৭৩
সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর
মান্না দে
সলিল চৌধুরী
১৯৭২
(১) বিবাহের (১৯৫৩)আগে গীতা দত্তর গান গীতা রায় নামে রেকর্ড হোত (২) গানের সন নানান সুত্র থেকে নেওয়া, সব সঠিক নাও হতে পারে।

অন্য প্রাদেশিক ভাষায় কানুবাবুর গান
কানুবাবু দুটি হিন্দী ছায়াছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন --"নয়া জামানা"(১৯৫৭)ও "প্যার কি রাহে"(১৯৫৯)। সলিল চৌধুরীর সহযোগী হিসেবেও উনি অনেক ছায়াছবিতে কাজ করেছেন ("মধুমতী", "ছায়া", "মায়া" ছায়াছবির  গান এখনো সমান জনপ্রিয়। প্রেম ধাবানকে সংগীতে সহযোগ করেছিলেন "শহীদ" ছায়াছবিতে।

সলিলবাবু'র স্ত্র্রী এবং প্রখ্যাত গায়িকা সবিতা চৌধুরীর কাছে শোনা একটা মজার গল্প।"মধুমতী"র গানের অনুশীলন চলছে, একটা গজল গান তাতে থাকবে। সলিলবাবু সেই গানের সুর দিতে গিয়ে বারবার নাজেহাল হচ্ছেন, কিছুতেই নিজের মন ভরছে না। শেষে হাত উঠিয়ে নিয়ে বললেন, "গজল আমার কাজ  নয়, ভাই কানু, তুমি এটা সামলাও"।কানুবাবু সুর দিলেন, শোনালেন সলিলবাবুকে, খুব খুশি উনি, সামান্য পরিবর্তন করে ফাইনাল করে দিলেন ওই গানটি --"হাম হাল এ দিল সুনায়েঙ্গে" (মুবারক বেগম)সবার তারিফ পেয়েছিল।

কানুবাবু কয়েকটি মালয়ালম ও কান্নাডা ছায়াছবিতেও কাজ করেছেন। মালয়ালম ছায়াছবি "নাজ্হিকাক্কাল্লু"র (১৯৭০) সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন উনি, যার একটি গান ("নিন পড়ান্গালিল") সব সময়ের প্রিয় মালয়ালম ছায়াছবির গানগুলির মধ্যে গোনা হয়। সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন কান্নাডা ছায়াছবি "প্রতিমা"র (১৯৭৮), সলিলবাবুর সহযোগী ছিলেন "সমস্যা ফলা"(১৯৭১) ছায়াছবিতে। "তিন বাত্তি চার রাস্তা" (১৯৫৩)নামের একটি বহুভাষী ছায়াছবিতে উনি একটি বাংলা গানের গীতিকার ও সুরকারের স্বীকৃতি পেয়েছেন।

শেষ সংযোজন:  বাংলা ছায়াছবি "গঙ্গা"র (১৯৬০) সহকারী সংগীত পরিচালক ছিলেন কানুবাবু, "রাত ভো" (১৯৫৬) ছায়াছবির নেপথ্য সংগীতেও সহায়তা করেছিলেন  (দুটোতেই সলিলবাবু ছিলেন পরিচালক)।




আরও পড়ুন:

http://www.harmonyindia.org/images/Red-song2.jpg




*****   এই লেখা থেকে যদি কেউ তথ্য নিয়ে অন্য কোনো ভাবে ব্যবহার করেন, আশা করব স্বীকৃতি প্রদান করবেন।