আধুনিক বাংলা
গানে কল্পচিত্র
গানে গানে গল্প ও ভাবনার চলচ্চিত্র আঁকা আধুনিক বাংলা গানের
অনেক পুরানো বৈশিষ্ট। ঘুমপাড়ানী ছড়া, যা শুনতে শুনতে
আমাদের শৈশবে রাত্রির শুরু হত, সে তো অনেক আগেই ছিল, সময় এগোতে তার সাথে
যুক্ত হলো আধুনিক গান। ছড়া বলতে বলতে, গাইতে গাইতে মা-ঠাকুমা-দিদিমা শিশু মনে কল্পনার চিত্র এঁকে
দিতেন, ঘুমের চোখে শিশু দেখত রাজপ্রাসাদ, রাজকুমার, রাজকুমারীর অচীন দেশ, হৃদয়হীন রাক্ষস-রাক্ষসী, পক্ষীরাজ ঘোড়া, প্রান ভ্রমর, তুফানী সাগর -- কল্পনার রঙের প্রলেপ দিত
ক্লান্ত চোখের পাতায়। আধুনিক বাংলা গান সেই ঐতিহ্য থেকে অনেক লাভবান হয়েছে,
এগিয়ে নিয়ে গেছে সেই ধারা, নানান সংযোজনে। রূপকথার সাথে সাথে
যুক্ত হয়েছে সমসাময়িক সমাজ চিন্তা ও বাস্তবতা, ছবি আঁকার পট পাল্টায় নি কিন্তু ছবির বক্তব্যে এসেছে
পরিবর্তন। কিছু আধুনিক গানের আলোচনা এখানে করব যেগুলোর কল্পচিত্র খুবই প্রভাবশালী
ছিল, সেই ছবির শোভাযাত্রা এখনো চোখ বুজলে দেখতে পাই। বিপরীতে, "সারাটি দিন ধরে চেয়ে আছিস ওরে", "শূন্যে ডানা মেলে পাখীরা উড়ে
গেলে" কিম্বা "এই তো বেশ এই নদীর তীরে বসে গান শোনা"
হলো এক একটা স্থির চিত্র, একটা বিশেষ সময়ে জমে থাকা
ছবি, চলচ্চিত্র না।
সলিলবাবুর "গাঁয়ের বধূ " ছিল কল্পচিত্রের পূর্ণ
দৈর্ঘ্যর ছবি, ক্যামেরা গ্রামের পথ ধরে
পৌঁছায় কিষাণীর ঘরে, পট-বন্দী করে তার জীবনের
সুখ-দুঃখের দিনরাত -- সোনার ফসল, গাছের ছায়া, শালুক ভরা দীঘি, ক্লান্ত দিনের শেষে কিষানের সাথে মুখোমুখি বসার মুহুর্তগুলি। কিন্তু বেশীক্ষণ ধরে রাখা গেল না সেই সুখের দিনগুলি। নিদারুন খরা, খাজনা, দেনা, উঁচু হারের সুদ, জমি টুকরো হওয়া – চোখের সামনে সারি সারি ভেসে আসে শোষণ অত্যাচার বঞ্চনার অনাহার-মরণের শোভাযাত্রা। ভাঙ্গলো গ্রামীন অর্থ ব্যবস্থা, ভাঙ্গলো সুখের সংসার, আগাছা ভর্তি পোড়ো ভিটের ওপর ইতিহাসের মত টিঁকে থাকা ভাঙা কুঁড়ে ঘরের ওপর ক্যামেরার শেষটুকু ফিল্ম সমর্পণ করলেন সলিল, আর চোখের জল মুছলাম আমরা, যারা সেই গান বার বার শুনেছি। সম্ভবত সব চাইতে বেশি বিক্রীত বাংলা গানের রেকর্ড ছিল "গাঁয়ের বধূ "।
সলিলবাবু "রানার" সুকান্তর লেখায় সুর দিয়ে খেটে খাওয়া মানুষের ক্লান্তিকর জীবন ও জীবিকার কথা শোনালেন। চোখ
বুজে গানটি শুনলেই দেখবেন সেই কল্পচিত্র, সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলা ক্লান্তিহীন যান্ত্রিক পরিশ্রমী সেই গ্রামের লোকটিকে – অন্ধকার রাতে খালি পায়ে ঘুঙুর বেঁধে হাতে একটা লাঠি আর পিঠের ওপর চিঠি ও টাকা ভর্তি একটা বিশাল ব্যাগ নিয়ে সে ছুটছে স্টেশন এর দিকে, অতি ভোরের মেইল গাড়ি ধরার জন্য -- জমা দেবে
সাথে আনা ব্যাগ, আর নেবে নতুন চিঠির ব্যাগ, গ্রামের বাড়ি বাড়ি বিলি করার জন্য। সুকান্ত মেহনতী মানুষ ও তার জীবিকার
বিচ্ছিন্নতার বিষয়টা খুব সুন্দর উপস্থাপনা করেছেন এই কবিতার জায়গায় জায়গায়।
চিত্রের অন্যভাগে দারিদ্রের চাপে নুইয়ে পরা অর্ধভুক্ত রানার-বধূ একেলা রাত্রি জেগে
কাটায় রানার এর ঘরে ফেরার পথ চেয়ে। শেষে ভোর
হলো, নতুন আশার সূর্য উঠলো, রানার জীবনে নতুন
সকাল আনলো সুদিনের প্রতিশ্রুতি। অপূর্ব সেই ভোরের ছবি।
প্রায় একই ছবি আঁকে "পালকির গান", তাতে গ্রাম জীবনের নানান ছোট ছোট ছবি আছে, এক লহমায় কবি সত্যেন্দ্রনাথ সেগুলো দেখেছেন বেহারাদের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে। কিছুই নজর এড়ায়
নি, মনের ক্যানভাসে সব ছোট ছোট দৃশ্য ধরা পড়েছে। ছয় বেহারার পাল্কী দুলকী চালে গ্রামের পর
গ্রাম পেরিয়ে এগোচ্ছে, সাথে রৌদ্রের তাপ বাড়ছে। কখনো গ্রামের
দৃশ্য একে একে পিছনে চলে যাচ্ছে (ময়রা
মুদি ঢুলছে কসে, গরুর বাথান, কণ্ঠী বাঁধা বৈরাগী, পুকুর ঘাটে বাসন মাজায় ব্যস্ত গ্রামের বৌ, ছুটে আসা নাংটা খোকা, পাঠশালা থেকে আসা পড়ুয়াদের আওয়াজ, পোড়ো ভিটের পরে চড়া ছাগল)কখনো আবার সেই রুক্ষ মাঠের আল পেরিয়ে তপ্ত তামার মতো
গরম মাটির ওপর দিয়ে দৌড়ে চলার ছবি,
ওপর থেকে দেখছে ডানা মেলা
শঙ্খচীল। পায়ের ছন্দ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে, শরীরে অবসাদ ও ক্লান্তি নেমে আসছে, সূর্য বাঁধের দিকে ঢলছে, শরীরের শেষ শক্তিটুকু নিয়ে ছয়
বেহারা সেই আলোআঁধারীতে চলছে গন্তব্যের লক্ষ্যে। চোখের সামনে ভাসে তাদের ঘর্মাক্ত শরীর, হাত-পায়ের স্ফীত পেশী রেখা আর নাক-মুখের গরম নিঃশাস। পরিশ্রমী মানুষের জীবিকার একটা দিনের এর থেকে ভালো ছবি কটা পাবেন? গোর্কীর মত আপনিও
বলবেন, "মানুষ", এই শব্দটা শুনলে
আমার মন গর্বে ভরে যায়।
ইছামতীর তীরে সোহাগী কঙ্কাবতী ঘর করতো কিষান স্বামীর সাথে। খেত ভরে থাকত সোনার ফসলে, ছিল না অভাব। চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে দিন কাটতো তার। কিন্তু সুখেরও শেষ আছে, সেই কঙ্কাবতীর জীবনে নামল দুর্দিন, হারালো কিষান কে, হারালো মাথা গোঁজার আশ্রয়। আর ইছামতির ঘাটে সেই
কাজলা শাড়ী আর নাকে নোলক পরা কঙ্কাবতীকে দেখা
যায় না -- "শীর্ণ দুটি বাহু তুলে" সে এখন দুয়ারে
দুয়ারে অন্ন ভিক্ষা করে বেড়ায়। কঙ্কাবতীর জীবনের
একটাই এখন আশা, শিশু চম্পাবতীর জীবন সুখের হবে, আবার ইছামতীর কূলে বসবে এক সুখের সংসার।"কঙ্কাবতীর কাঁকন" গানের কথা যতটা না বর্ণনা করে তার থেকেও
বেশি ভাবায়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই নদী, গ্রাম আর
কঙ্কাবতীর জীবন কথা। শ্রী অনল চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘের এক উজ্জল নাম, সলিল বাবুর খুব ঘনিষ্ট, গান লিখতেন যেমন ভালো, সুরও দিতেন তেমনি। সেই অনলই লিখেছিলেন এই গান ১৯৫৬-এ, তাতে সুর দিয়েছিলেন শ্রী শ্যামল মিত্র -- গানের সুর শুনবেন
না আবহ সঙ্গীত? দুটোই অপূর্ব।
শ্রী যতীন্দ্রমোহনের কবিতার আধারে ১৯৫৫-এ শ্রী সুধীন দাশগুপ্ত সুর বাঁধলেন "বাঁশ বাগানের মাথার উপর"। নিজের অজান্তে চোখের জলে কাজলাদিদির কল্পচিত্র ধুয়েছেন না জানি কত শ্রোতা, এমনই সেই গানে হারানোর ব্যথা। কাজলা দিদি আমাদের সবার দিদি, রোজ রাত্রে যার “শোলক” শুনতে শুনতে ঘুমিয়েছি, হারানো সেই আদরের দিদিকে এখনো চোখ খুঁজে বেড়ায় নিঃসঙ্গ রাতের অন্ধকারে --জোনাকীর আলো, ফুলের গন্ধ, ঝিঁঝিঁর ডাক -- সব কিছুতেই পাই অদেখা দিদির ছায়াস্পর্শ, চোখের ঘুম মুছে ফেলে জেগে থাকি অন্ধকার রাত্রে, পাছে দিদি এসে ফিরে যায়! শিল্পী প্র্তিমা যখন সুরে সুরে বলেন
"সেদিন হতে কেন মা আর দিদিরে না ডাকো, দিদির কথায় আঁচল
দিয়ে মুখটি কেন ঢাকো" তখনি গান তা বন্ধ করে দেই, সেই কঠিন বাস্তবের মুখোমুখী হবার মত মনের জোর কোথায় ? কাজলা দিদি বার বার শুনি আর আঁকি সেই অন্ধকারে হাতছানি দিয়ে পুকুরের চারপাশে
ঘুরে বেড়ানো কুহেলী দিদির ছবি।
গরবিনী মা'র চোখের সামনে
তার আদরের খোকন শৈশব, কৈশোর পার হয়ে যৌবনে পা দিল আর তার বিবরণ দিল
প্রণব রায়ের লেখা ও নিতাই ঘটকের সুর দেওয়া
গান "আমার সোনা, চাঁদের কণা"। প্রায় ছয় মিনিটের দৈর্ঘ্যের
সেই গানের ব্যাপ্তি ছিল অনেক বড়, অনেক বড় সেই
কোলাজ, গল্পের অঙ্ক পাল্টাছে, তার সাথে পাল্টাছে কল্পচিত্রের বিষয়। স্নেহমাখা দৃষ্টিতে অপলকে চেয়ে আছে মা
তার কোলের শিশুটির দিকে, তার ঝলমলে হাসিতে মা'র মুখ খুশিতে ভরে ওঠে, স্পর্শে স্পর্শে বারে মা-সন্তানের মধুর
সম্পর্ক। দু'বছরে খোকন আধো আধো কথা বলতে শিখল, দুধের বাটি ফেলে দেয় দৌড় আর সেই
দস্স্যি ছেলের ওপর নজর রাখতেই সময় যায় মা'র। তিন বছরের
খোকন মায়ের চোখের জল মুছিয়ে প্রতিশ্রুতি দেয়, একদিন সে পক্ষীরাজে চড়ে পৃথিবী জয় করবে, মা কে খুশি করবে। পাঁচ বছরে গেল
পাঠশালাতে, মায়ের প্রশংসা
বিছানো পথ দিয়ে। সময় এগোলো,
খোকন বড় হলো, আরও আগে জীবনে তার মধুবসন্ত এলো, খুশীতে উচ্ছল মা
খোকন কে আশীর্বাদ দিয়ে পাঠালো বিয়ের আসরে, উলু দিয়ে করলো
বধূবরণ, এতদিনে তার খোকনকে পালন করার সম্পূর্ণতা খুঁজে
পেল সে। শিল্পী প্রতিমা সেই ১৯৯৫-এ এই গান গেয়েছিলেন, সব খোকনের মা এখনো সেই ছবি এঁকে চলেছেন।
সজলপুরের সুন্দরী কাজলা মেয়ে স্নানের বিলাসিতায়
নেমেছে গাঙের জলে। আজ তার ধূলা খেলা, কাল হবে তার
বিয়ে। নোটন পায়রার দল দেখছে সেই নিলাজ মেয়ের স্নান। মধুমতী বেয়ে যাবার সময় সেই রূপ
দেখল এক রাজকুমার। তার ডাক শুনে হরিনীর মত নিমেষে দৌড়ে পালালো মেয়ে, দীঘির পাড় বেয়ে।
সজলপুরের সেই কালো মেয়ে আর স্নানে আসেনা কিন্তু সেই রাজকুমার এখনো তার প্রতীক্ষায়
নাও বেঁধে বসে আছে মধুমতীর ঘাটে। সুন্দর কল্পচিত্রের এই গান গেয়েছিলেন শিল্পী
আল্পনা, খুব জনপ্রিয় ছিল এক সময়।
আরও অনেক গান আছে যে গান শুনে আপনার আমার মনে
কল্পচিত্র ভেসে ওঠে, কে কোন রঙে রাঙাবে সেই ছবি নির্ভর করবে গানের
কোন দিকটা কার কল্পনাকে উস্কে দেয়।
কল্পচিত্রের সুন্দর
কয়েকটি গান
|
||||
গান
|
শিল্পী
|
গীতিকার
|
সুরকার
|
সন
|
কোন গাঁয়ের বধূর কথা
|
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
|
সলিল চৌধুরী
|
সলিল চৌধুরী
|
১৯৪৯
|
রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম
|
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
|
সুকান্ত ভট্টাচার্য
|
সলিল চৌধুরী
|
১৯৫১
|
পাল্কীর গান
|
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
|
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
|
সলিল চৌধুরী
|
১৯৫২
|
কঙ্কাবতীর কাঁকন বাজে
ইছামতীর কুলে
|
প্রতিমা বন্দোপাধ্যায়
|
অনল চট্টোপাধ্যায়
|
শ্যামল মিত্র
|
১৯৫৬
|
বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই
|
প্রতিমা বন্দোপাধ্যায়
|
যতীন্দ্রমোহন বাগচী
|
সুধীন
দাশগুপ্ত
|
১৯৫৫
|
আমার সোনা, চাঁদের কণা
|
প্রতিমা
বন্দোপাধ্যায়
|
প্রণব রায়
|
নিতাই ঘটক
|
১৯৫৩
|
সজলপুরের কাজল
মেয়ে নাইতে নেমেছে
|
আল্পনা
বন্দোপাধ্যায়
|
ভাস্কর
বসু
|
নচিকেতা ঘোষ
|
***** এই লেখা থেকে যদি কেউ
তথ্য নিয়ে অন্য কোনো ভাবে ব্যবহার করেন, আশা করব স্বীকৃতি প্রদান করবেন।
Ei bishoyti besh bhalo laglo. Dhonyobaad.Shudhu apnari dewa ekti tothyo ami shamanyo onyorokom peyechhi...jodi bhul kore thaki thaki, shongshodhan koreben. "Amaro shona chandero kona" ganti 1953 shaler gaan khub shombhaboto.
ReplyDeleteআমার তথ্য অনুযায়ী ১৯৫৫ (যদিও পুরানো গানের ব্যাপারে অনেক পরস্পরবিরোধী তথ্য পাওয়া যায়), কিন্তু গ্রহণযোগ্য কোনো রেফারেন্স পেলে নিশ্চই সংশোধন করে নেব। ধন্যবাদ।
Delete"আমার সোনা চাঁদের কণা" -- আমি প্রতিমা বন্দোপাধ্যায়ের এই গান ভুলবশতঃ ১৯৫৫ লিখেছি। আপনাকে ধন্যবাদ,গানটি ১৯৫৩'র।
ReplyDelete