সিঁথির
স্মৃতি -- উত্তর
কলকাতার এক
শহরতলীর গল্প (১৯৫৪-১৯৬৬)
ভালো করে রাতের আঁধার নামার আগেই কাঁধে একটা ছোট মই নিয়ে কালীচরণ ঘোষ রোডের রাস্তার গ্যাস লাইটগুলো জ্বালিয়ে যেত কর্পোরেশনের লোক, প্রায় একই সাথে পায়ে ঘুঙুর বেঁধে এক নামতো এক ঘুগনীবালা তার নিয়মিত রাস্তায়, শাল পাতায় সেই ঘুঘনী খাবার জন্য পাড়ার মোড়ে অপেক্ষা করতো ছেলে-মেয়ে-বৌয়েরা।"বুড়ির মাথার পাকাচুল" অনেক আগেই তার বাড়ি ফিরে গেছে অল্প বয়েসীদের মন খুশি করে, আরও একটু সময় এগোলে আসবে "কুলফীয়ালা", বড় মাটির হাঁড়িতে বরফের মধ্যে রাখা টিনের খোলস থেকে কুলফী বের করে তার ওপর ছড়িয়ে দেবে সিদ্ধির মশলা, তার হ্যাজাকের আলোয় বড়োরা দাঁড়িয়ে খাবে সেই কুলফী। সেই ১৯৫৫/৫৬ পেরোতেই নতুন করে বনলো সিঁথির মোড়-কালীতলার রাস্তা, আসলো নাক থ্যাবড়া ৩২-যাত্রীর সরকারী বাস ৩০/এ , কালীতলা থেকে শ্যামবাজার
(আরও পরে যার শেষ স্টপ বাড়িয়ে করা হয়েছিল রেললাইন পর্যন্ত), আর
প্রায় সেই সাথেই রাস্তায় বসলো ইলেকট্রিক লাইটপোস্ট। অল্প বয়েসী আমরা অপেক্ষা করতাম কখন বাস এসে ১০ মিনিটের জন্য জিরোবে, ড্রাইভার আর কন্ডাকটর যাবে পান-বিড়ির দোকানে, আর
সেই ফাঁকে আমরা বাস এ ঢুকে হুটোপুটি করবো, যতক্ষণ পর্যন্ত না ড্রাইভার এসে আমাদের খেদাবে।
সেই কালীতলার মোড়েই ছিল রানী রাসমণির এক পুরানো ভাঙা পোড়ো বাড়ি, যেখানে আরও গুটিকয়েক পূর্ব বাংলার উদ্বাস্তুদের সাথে আমাদের পরিবার আস্তানা নিয়েছিল। সেই নরককুন্ডের বসতিকে স্থানীয় বাসিন্দারা অনুকম্পার তাচ্ছিল্যে "রিফিউজী বাড়ি" বা "বাঙাল বাড়ি" বলেই ডাকতো।
সেই বাড়ির পেছনের সরু গলি দিয়ে সামান্য এগোলেই পড়তো ফকির ঘোষ কলোনী আর তার এক উপাঙ্গ
ডি.গুপ্ত লেন। সেই সরু গলিতেই ছিল গুপ্তদের পারিবারিক বাড়ি,বড়
মেয়ে রেনুদি গননাট্য সংঘের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। অনেক অনেক পরে শুনেছিলাম রেনুদি ওনার বন্ধু ও সংঘেরই অন্য কর্মী দিলীপদা কে বিয়ে করেছিলেন। আজ থেকে বছর ২৫ আগে একবার বিশ্বনাথ পার্কে রেনুদির সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সেই রেনুদি যিনি এক অষ্টমীর দিন লক্ষ্য করেছিলেন আমার গায়ে নতুন জামা নেই,পরের দিন আমাকে ডেকে দিয়েছিলেন একটা নতুন কেনা হাফ-শার্ট। জলে ধোয়ার পরই মাড় উঠে যাওয়া সে জামা আমি বালিশের নিচে ভাঁজ করে রেখে কালীপূজাতেও পড়েছিলাম। বয়েসের ভারে ঝুঁকে পড়া রেনুদি সেই অপরিসর ঘরে কয়লার উনোনে রুটি বানাতে বানাতে পুরনো গল্প বলছিলেন (আর আমি ভাবছিলাম সেই হাফ-শার্টের কথা, যা
পড়ে আমার কৈশোরের এক নবমী খুশীতে ভরে উঠেছিল)।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ তখনও ৫৬-এ বি.টি.রোডে স্থানান্তরিত হয়নি, লাগোয়া "মরকতকুঞ্জ"-এ ঠাকুরবাড়ীর সম্পত্তি)তখনও আস্তানা গাড়েনি আই.আই.এম. (পরে সেখানে প্রথমে আসে রাজ্যের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ও পরে “রবীন্দ্রভারতী”)।
যেমন বাকি কলকাতায় হতো, সিঁথির প্রায় সব সার্বজনীন পূজা সমিতিগুলো পূজার তহবিলের একটা ভাগ সরিয়ে রাখতো পূজার পরের সাংস্কৃতিক অনুষ্টানের জন্য। যত বড় তহবিল, তত জমিয়ে বসত হতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান -- গান, নাচ, আবৃত্তি।স্থানীয় শিল্পীদের সেটা একটা বড় সুযোগ দিত নিজেদের পারদর্শিতা দেখানোর -- সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে না দেখা পর্যন্ত চশমাপরা জয়শ্রীদিই (থাকতেন রেল লাইনে এপারে, ঠিক মোড়ের মাথায়) ছিলেন আমার সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। মুগ্ধ হয়ে শুনতাম যখন জয়শ্রীদি হার্মোনিয়াম বাজিয়ে গাইতেন "মধুমালতি ডাকে আয়" (আরও বছর দুই পরে প্রথম দেখেছিলাম সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় কে, সম্ভবতঃ ১৯৬৩/৬৪-এ -- টালা পার্কের অনুষ্ঠানে -- "ও বক বক বক বকম বকম পায়রা" আর "পিয়া পিয়া পিয়া কে ডাকে আমারে", ওনার গাওয়া এই দুটি গান মনে আছে; টালা পার্কের অনুষ্ঠান খুব বড় হতো, সব জনপ্রিয় শিল্পীদের ওখানেই প্রথমে দেখি (সীমিত গন্ডীর বাইরে তখনো কেউ শোনেনি পিন্টু ভট্টাচার্য বা আরতি মুখোপাধ্যায়ের নাম) -- নাম লিখতে গেলে পাতা ভরে যাবে।
সেই ১৯৬২/৬৩ তে প্রথম দেখি মান্না দে কে। আলবার্ট ডেভিড বাস স্ট্যান্ডের উল্টো দিকে ছিল কাগজকল (এখন যেখানে আছে হাউসিং এপার্টমেন্টস), তাদের বার্ষিক অনুষ্টানে। পুরু গোঁফ, মোটা কালো ফ্রেমের চশমা, সাদা পায়জামার ওপর নস্যি রঙের পাঞ্জাবী, হাতের আস্তিন প্রায় বাইসেপ্স পর্যন্ত গোটানো, গলায় মাফলার হালকা করে জড়ানো (না, তখনো টুপী পড়া শুরু করেন নি, মাথায় কমবেশী চুল ছিল)-- পাড়ার "দাদা"-র স্টাইলে ভাড়ার ট্যাক্সি থেকে নামলেন মান্না দে । একের পর এক নিজের সেরা গানগুলো গেয়েছিলেন, বিশেষ করে মনে আছে "তীর ভাঙ্গা ধেউ" আর "কত দূরে আর নিয়ে যাবে বলো"। ফকির ঘোষ কলোনী'র বাস স্ট্যান্ডের লাগোয়া ছিল একটি খালি ছোট মাঠ, সেখানে একবার প্যারোডি শিল্পী মন্টু দাসগুপ্ত খুব মজার সব গান শুনিয়েছিলেন।"আমি আগন্তুক আমি বার্তা দিলাম" (মান্না দে, "শঙ্খবেলা" ছায়াছবি) প্যারোডির একটা টুকরো এখনো মনে আছে, "জনসন, হাতে নিয়ে মেগাটন" (ভিয়েতনাম যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে)। ফকির ঘোষ কলোনী'র জলসাতেই প্রথম শুনি তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় (গেয়েছিলেন "তাজমহল") -- সিঁথির ঠিক কোন পাড়ায় মনে নেই, এই রকমই এক অনুষ্টানে মৃনাল চক্রবর্তীকে প্রথম গাইতে শুনি (শুনিয়েছিলেন ওনার সে সময়ের খুব জনপ্রিয় গান "ঠুং ঠাং ঠুং ঠাং চুড়ির তালে")।
সেই ফকির ঘোষ কলোনীতেই দেখেছিলাম, সম্ভবতঃ ১৯৬২-৬৩'তে, অতি ছোট্ট গড়নের বর্ষীয়ান, অতীতের দিকপাল ফুটবল খেলোয়াড় গোষ্ঠ পালকে, শৈলেন মান্না'র হাত ধরে -- হাঁটু পর্যন্ত উঠিয়ে পড়া ধুতি ও পাঞ্জাবী -- ট্যাক্সি থেকে নামলেন, স্থানীয় ফুটবল ফাইনালের পুরস্কার বিতরণের জন্য।
হরেকৃষ্ণ শেঠ লেনে থাকতেন এক অতি সম্মানিত সংগীতজ্ঞ ও এক সময় আকাশবাণীর সংগীত বিভাগের প্রধান, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ (পরে জেনেছি, পাশের বরানগরেই থাকতেন গীতিকার মিল্টু ঘোষ)। কিন্তু ঘরের পাশেই যে "উত্তর কলকাতার সলিল চৌধুরী" থাকতেন সেটা তেমনি করে বুঝে উঠতে পারিনি সেই অল্প বয়েসে -- শ্রী সুধীন দাশগুপ্তর কথা বলছি।
ফকির ঘোষ কলোনী'র শেষ প্রান্তে,
ডি.গুপ্ত লেনে, প্রায় আলবার্ট ডেভিডের গলি শুরু হবার আগে,
"সুধীন'দা" থাকতেন -- আমাদের থেকে বয়েসে প্রায় বছর কুড়ির বড় হওয়া সত্ত্বেও তাকে ওই নামেই আমরা অল্পবয়েসীরা চিনতাম, যেই নামে গণনাটা সংঘের রেনু'দি-দিলীপ'দা ও অন্যান্যরা তাকে সম্বোধন করতো। প্রায়ই দেখতাম হাতে গানের কোনো বাজনা নিয়ে তারা সুধীন'দার বাড়ি যাচ্ছে,
মানে গনসংগীতের কোনো মহড়া হবে। সেটা ছিল ১৯৬০-৬৪, জানতামও না যে ভদ্রলোক কত নামকরা গীতিকার-সুরকার ছিলেন। সে বাড়ীর পাশ দিয়ে গেয়ে হারমোনিয়ামের চাপা আওয়াজ কখনো কখনো শোনা যেত,
ওই পর্যন্তই -- কত সেরা সেরা গানের যে সুর সৃষ্টি করেছেন ওই বাড়িতে তখন বুঝিনি,
কখনো কৌতূহল হয়নি জানতে কোনো কোন নামকরা গায়ক-গায়িকা ওই বাড়িতে আসতেন ওনার সাথে দেখা করতে। সেই বয়েসে গায়ক/গায়িকার খবর রাখতাম, কার গান,
সে সুর দিয়েছেন, সে ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহ ছিল না।স্থানীয় লোকেরা তাকে খুবই প্রশংসার নজরে দেখতো, সন্মান করতো, যদিও পাড়ায় আড্ডা মারতে দেখিনি কখনো।ফকির ঘোষ কলোনীর স্টপেজে বাসের জন্য অপেক্ষা করতেন সেই দীর্ঘাঙ্গ সুপুরুষ লোকটি, পরনে ধবধবে পাজামা-পাঞ্জাবী, সৌখিন গোঁফ, মোটা ফ্রেমের চশমা -- নির্বিকার দাঁড়িয়ে রয়েছেন রোদ্দুরে,বাসের প্রতীক্ষায়।
আর কালীতলার স্ট্যান্ডে দুপুর বেলায় বাস ধরার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতেন রূপালী পর্দার অভিনেতা দ্বিজু ভাওয়াল -- ফর্সা,
মাঝারি লম্বা,
পরনে প্যান্ট-শার্ট, রঙিন চশমায় মুখ ঢাকা,
পকেটে হাত ঢুকিয়ে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন সচেতন উদাসীনতায়। ফিরতি দুপুরের বাসেই মাঝে মাঝে দেখা যেত বিশ্বশ্রী মনতোষ রায়কে -- যেতেন সেই লাইনের স্টপেজে কোথাও – খর্বকায়, কালো চশমা, স্ফীত হাতের পেশী, মাথায় ঝাঁকড়া চুল,
সব সময় লাস্টের সিটে বসতেন ।
১৯৬৬-এ সিঁথি ছাড়ি,
কিন্তু স্মৃতিগুলো এখনো তাড়িয়ে বেড়ায় অবসর সময়গুলোকে। না কোনো মান্না দে আজ ভাড়ার গাড়ি চড়ে পাড়ার অনুষ্টানে গাইতে আসেন, না কোনো সুধীন দাশগুপ্ত বাস ধরার জন্য রোদ্দুরে বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছেন, না কেউ রাত জেগে চাদর মুড়ি দিয়ে মাটিতে বসে টালাপার্কের মতো সার্বজনীন অনুষ্ঠানে শুনছে সন্ধ্যা-শ্যামল-সতীনাথ-প্রতিমার গান (কখন চলে গেছে শেষ শ্যামবাজার-সিঁথির বাস)।
khub bhalo laglo lekhati pore. Khub antorik bhabe smriti romanthan kora hoyechhe.
ReplyDelete