Sunday, June 9, 2019

বরানগর বাজার (১৯৬০/৬৫ 'র গল্প)

বরানগর বাজার .... (১)

কাকডাকা ভোরে বরানগর যখন আলমোড়া ভেঙে শেষ ঘুমটাও চোখে নিংড়ে নিচ্ছে, রাস্তা যানবাহনহীন, সব আলোও নেভেনি, তখন বরানগর বাজারের মুখে ব্যাপারীদের প্রাত্যহিক কর্মব্যস্ততা। মাটিতে বসে খবরের কাগজের হকাররা কাগজের বান্ডিল বানিয়ে সাইকেলে বাঁধছে বিলি করতে যাবে বলে, ট্রাক/ ভ্যান/রিকশা থেকে নামানো হচ্ছে বাজারের শাকসব্জী মাছ, এরই মাঝে ম্যুনিসিপালিটির সাফাই কর্মচারী মোটা ঝাঁটা নিয়ে জঞ্জাল পরিষ্কারে ব্যস্ত। নানান বাহারী ফল সবজীর লাল-সবুজের খেলা চলছে বাজারের ঢোকার মুখে। সামনের জমিতে জল ছিটিয়ে ফুলের দোকানের ব্যাপারী মাটিতে চট পেতে সাজাচ্ছে ফুল বেলপাতা তুলসীপাতার পশরা, তার বৌ বানাচ্ছে মালা, লাল জবা আর গাঁধা ফুল দিয়ে। উনুনের নিচে সমানে হাত পাখা নেড়ে চলেছে চায়ের দোকানের লোক, ঘুঁটে-কয়লার ধুঁয়ায় বাতাস ভারী হয়েছে -- দু'একজন ইতিমধ্যেই তাগাদা দিয়ে গেছে চায়ের জন্য। আওয়াজ করে ঠিক মোড়ের মাথার স্টেশনারী দোকানের ঝাঁপ খুললো আর প্রায় সেই সাথেই ভ্যানে আসলো মাখন পাঁউরুটির ডেলিভারী, মন্দিরের ঘন্টা বাজিয়ে শুরু হলো প্ৰাতঃপ্রণাম। মিষ্টির দোকানের বাইরে টুলে বসে সদ্য নামানো সিদ্ধ আলুর গরম খোসা ছাড়াচ্ছে এক কর্মচারী, নিচে পরে এক রাস কড়াইশুঁটির খোসা -- সিঙ্গারা বানানোর প্রস্তুতি চলছে। দোকান সাজাতে গিয়ে ডিমের দোকানীর হাত থেকে মাটিতে ভেঙে পড়লো ২-৩'টা ডিম, রাস্তার কুকুর সেটা চাটতে আসতেই তার টায়ারের চপ্পল দিয়ে তার ওপর সব রাগ উজাড় করলো দোকানী, বাজারের চালের ওপর থেকে সে দৃশ্য দেখলো লেজ গুটিয়ে বসে থাকা লাল-সাদা মিনি। বগলে আজকের খবরের কাগজ গুঁজে ষ্টেশনারী দোকানে আসলো এক খদ্দের -- ঠান্ডা মাটির জলের পাত্রে রাখা মাখনের ১৫০/২০০ গ্রামের ছোট ছোট প্যাকেট, আঙ্গুল ডুবিয়ে ২টা মাখনের প্যাকেট নিল, নাকে পাঁউরুটির ঘ্রান নিয়ে তাজা ভাব পরীক্ষা করে এক প্যাকেট পাঁউরুটি কিনে পয়সা দিয়ে চলে গেলো। মাটির ভাঁড়ে চা আর তার সাথে S-বিস্কুট খেয়ে কাগজের হকাররা যে যার রুটে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। রিকসায় আসলো ছোট মাছ, বড় বড় ড্রামে জল নাড়িয়ে মাছ তাজা রাখছে ব্যাপারী, এক এক করে নিয়ে যাওয়া হবে মেছুয়াদের লাইনে। দিনের আলো তেজ হবার আগেই বরানগর বাজার তৈরী খদ্দেরদের অভ্যর্থনার জন্য -- সারাদিন চলবে দর কষাকষি, লাভ-লোকসানের লড়াই। চৌমাথার ভাড়া বাড়িতে থাকা কাবুলিওয়ালারা কাঁধে ঝোলাভর্তি আখরোট পেস্তা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো তাদের জীবিকার সন্ধানে। আর তখনি নরেন্দ্রনাথের পড়ুয়ারা অলিগলি থেকে বেরিয়ে পড়লো সকালের কোচিং ক্লাস করতে।

বরানগর বাজার .... (২)

বেলা আটটা। গড়িয়ে গড়িয়ে বনহুগলী থেকে এসে পৌঁছলো ৩২ নম্বর বাস, সামান্য কয়েকজন যাত্রী। কোনো জলদিবাজী নেই -- অল্পক্ষণের জন্য বাস থামিয়ে ড্রাইভার মা কালীর ফটোর সামনে একটা ধুপকাঠি জ্বালিয়ে পেন্নাম করলো। হাতের টিকেটের বান্ডিলে আঙ্গুল ঘষে কন্ডাক্টর একটা বিচিত্র আওয়াজ করে হাঁক মারলো, যদি ওঠার জন্য কোনো যাত্রী থাকে। তখনো সময় হয়নি যাত্রী আসার, অগত্যা বাস কালো পাথরের ইঁটে সাজানো কাশীপুরের রাস্তায় এগিয়ে গেলো, অসমতল সেই রাস্তায় দরজা জানালার ঝাঁকানিতে খোল কীর্তনের আওয়াজ তুলে। ড্রাইভার মাঝে মাঝে আরশিতে দেখে নিচ্ছে পেছনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ৪ নম্বর বাস আছে কি না।
লুঙ্গি পাজামা পরে লোকেরা আসছে বাজার করতে। হাতে আনাজ আমিষ ও বিবিধ উপকরণের জন্য ২-৩ টা ছোট বড় ব্যাগ, অনেকদিন না ধোয়ার জন্য তাদের আসল রং বোঝা যাবে না। সময় কম, তাড়াতাড়ি বাজার ফেরত হলেই গিন্নীরা ভাত-ডাল-মাছের ঝোলের সংক্ষিপ্ত ব্যঞ্জন বানিয়ে দিতে পারবে, কোনো মতে মুখে দুটি গুঁজেই কর্তারা দৌড়োবে অফিসমুখো, হয় বি.টি.রোড বা বরানগর বাজার থেকে বাস ধরে, তার পেছনে কিছু পরেই বেরোবে স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা।
বাজারের বাঁ দিকের গলির মুখের মিষ্টির দোকানে গরম সিঙ্গারা-নিমকির বিক্রী হচ্ছে, মালিক ঘাড়ের গামছা দিয়ে বেলের মোরোব্বার ওপর থেকে মাছি তাড়াচ্ছেন, কর্মচারীকে তাগাদা দিচ্ছেন তাড়াতাড়ি লেনদেন করার জন্য। সেটা পেরোলেই ছোট দোকানে ঠাসা মুড়ি গুড় বাতাসা নলেনগুড়ের মোয়া ইত্যাদির সামগ্রী। পাশেই দাঁড়িয়ে একজন বিক্রি করছে ধূপকাঠি, একটা নমুনা জ্বালিয়ে, খুব সুগন্ধী। কিন্তু এই তাড়াহুড়োর সকালে তাদের ওপর নজর নেই বাবুদের। এখান থেকে শুরু কাঁচা বাজারের -- মাটিতে চট কাপড় বিছিয়ে একের পর এক ছোট ছোট ব্যাপারীরা নিয়ে বসে আছে নানান সবুজ শাক -- কুমড়া পালং নটে মেথী পুইঁ পলতা, আছে কুমড়া ঢ্যাঁড়স পটল লাউ উচ্ছে বেগুন পটল। কোলে ছোট বাচ্চা নিয়ে এক বৌ বসেছে কাগজীলেবু শশা তালশাঁস পেয়ারা নিয়ে, তার পাশেই এক বুড়ীমা বসেছে মোচা আর কিছু কামরাঙ্গা নিয়ে। বাজারের ভিতরে আছে আলু পেঁয়াজ মাছ মাংসের দোকান, আছে মশলা ও চাল ডাল তেলের দোকান। এর মধ্যেই লোকের গা এড়িয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে কেটলী হাতে চায়ের দোকানের ছেলেটা, তার অন্য হাতে কয়েকটা মাটির ভাঁড়। ওখান থেকে বেরিয়ে আসলেই আবার বড় রাস্তা -- ডিম ফুল বেলপাতা ওখানে পাবেন।
বাবুরা তাড়াহুড়ায় বেশি দরদাম করতে পারছে না, বড় জোর পাল্লায় একটা বেশি আলু বা পেঁয়াজ, কোথাও আকারে বড় কিছূ নিয়ে জেতার ভাব করছে।
রাস্তার ওপারে রিকশা থেকে কেতাদুরস্ত সাদা পাজামা পাঞ্জাবী, পায়ে রাধুর শৌখিন চপ্পল পরে নামলেন হিরন্ময় বাবু -- বহুদিন বিদেশে থেকে শেষ জীবনে দেশে ফিরেছেন বছর দুই আগে। আজ ড্রাইভার আসেনি, তাই রিকশা। টুংটাং আওয়াজ তুলে লাইটার দিয়ে জ্বালালেন ক্যাপস্টান সিগারেট, রিকশাঅলাকে অপেক্ষা করতে বললেন। বাজারের গলিতে এক পা রেখেই জল কাদা দেখে পিছিয়ে গেলেন -- ইশারাতে বাঁধা মাংসের দোকানীকে ডাকতেই সে দৌড়ে এলো -- "২ সের পাঁঠার মাংস আর একটা মাঝারী ওজনের দেশী মুরগীর মাংস বাড়ীতে বৌদিকে দিয়ে আসিস, বেশি দেরী করিস না"। দামী চামড়ার পার্স থেকে কিছু টাকা বের করে তার হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, "বাকি টাকাটা তোর কাছেই জমা রেখে দিস", বলেই রিকশায় চড়ে ফেরত গেলেন।
রতনবাবু রোডের অনুপমবাবুর বাড়ীতে বাজার করা নিয়ে নিত্যি অশান্তি, প্রায় রোজই খারাপ মেজাজেই বাড়ী থেকে অফিসে যায়, গিন্নী বলে, "কি রোজ রোজ ওই এক ঘেয়ে থানকুনী-কাঁচাকলা আর চারা পোনা আনো, বাড়িতে সবারই কি পেটের ব্যামো আছে?" অনুপমও দমবার পাত্র নয়, জবাব তৈরী "শশুর বাড়ীতেই বা আমার পাতে কোন গলদা চিংড়ি আর পাকা রুইয়ের পেটী পড়ে ?" আজ বেচারা অনুপম ঠিক করেছে পনীর কিনবে, বৌ সত্যি খুব ভালো বানায় পনীর, ঘি গরম মশলা দিয়ে।
সচ্চাসী পাড়ার ধীলনবাবু রোজের মতো আজও ব্যাজার মুখে হাঁটু পর্যন্ত ঝুলে থাকা ২-৩টা বড় থলী নিয়ে বাজারে ঢুকলেন। তিন চাকুরে ভাইয়ের যৌথ পরিবারের বড় ছেলে উনি, বাবা মা তিন ভাইয়ের বৌ বাচ্চা ও কাজের লোক মিলিয়ে প্রায় জনা পনেরোর পরিবার, তিন ভাইই চাকুরে, আর্থিক অবস্থা বেশ ভালোই। এহেন ধীলনবাবুর পীড়া অন্যত্র -- ঠিক বাজারের সময় হলেই ভাইয়েরা বাথরুমে ঢুকে পড়বে, কাপড় ইস্ত্রি করবে বা অন্য কোনো অছিলায় পাড়ার দোকানে "এই আসছি" বলে বেপাত্তা হবে, ফলে বাজারের ঝামেলা এই ধীলনের ঘাড়েই পড়ে -- রোজ আলু পেঁজায় ২-৩টা বড় কফি মাছ -- এই সব দুই হাতে মুটের টেনে টেনে তাকেই আনতে হয়। তবে বাজারে ওনার হিতৈষী অনেক, "এই আড় মাছের পীসটা বাবু আপনার জন্য, ওটার দাম দিতে হবে না", মাছের দোকানী ওনার ব্যাগে আলাদা করে একটা ছোট মাছের ঢুকিয়ে দিয়ে বললো।
নবীন ডাক্তার মনোজিৎ, খুব স্বাস্থ্য সচেতন -- লাল মাংস ? নৈব নৈব চ -- মাছের কানকো উঠিয়ে দর্শনে সন্তুষ্ট হলেই সে মাছ কিনবে, সবুজ সব্জী গাজর-বীটের স্যালাড অনিবার্যভাবে খাবার টেবিলে চাই -- বাজার ঘুরে ঘুরে সে কলেজের নিউট্রিশনের চ্যাপ্টারে উল্লেখ করা কাঁচা ফলসব্জীর যা কিছু এই বাজারে পাওয়া যায় সে সব অল্প অল্প করে কিনলো।
প্রভাকর সদ্য পাশ করে চাকরীতে ঢুকেছে, তাই তারাতাড়ি বাজারে আসে যাতে অফিস যেতে একটুও দেরী না হয় -- মা নাকি ওর বিয়ের পাত্রী দেখেছে কিন্তু লজ্জায় এই ব্যাপারে মা'কে কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারেনি, সর্বক্ষণ কৌতূহল মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাজার শেষে হাতের ঘড়িতে দেখলো এখনো সময় আছে, মন্দিরের পাশে তেলেভাজার দোকানে বেগুনীতে এক কামড় দিতেই মনে পড়লো আজ বৃহস্পতিবার, লক্ষ্মীপূজার দিন -- বিয়ের ভাবনা ছেড়ে দৌড়োলো আবার সেই শেষের গলিতে পূজার ফুল বেলপাতা আমের পল্লব আর মিষ্টির দোকান থেকে গুজিয়া কিনতে।
শুভ্রকান্তিকে ওজনে বা দামে ঠকাবে, বাজারে এমন দোকানী হাতে গোনা যায়। কর্মসূত্রে তাকে প্রায়ই দিল্লি বোম্বাই করতে হয়, দুনিয়া দেখা লোক সে, তার নজরে কোথাও খুঁত ধরা পড়লে সে তৎক্ষণাৎ ফেরত দেবে -- কানা বেগুন, বুড়ো কাঁচকলা, পোস্তোয় পোকা --কিছুই তার নজর এড়াতে পারে না। মাছের দোকানে ওজন করার আগে পাল্লা উল্টে দেখেন চুম্বক লাগানো আছে কি না, এমনই কঠিন খদ্দের উনি। মাছওয়ালাও তেমনি, দূর থেকে ওনাকে আসতে দেখলেই চালানের রুই মাছের পেটীর ওপর টাটকা মাছের রক্ত মাখিয়ে সেটা শুভ্রকান্তিকেই গছিয়ে দেয় -- "খুব ভালো মাছ, খেয়ে দাম দেবেন বাবু "।
এই ভাবেই তাড়াহুড়ায় শেষ হলো অফিসবাবুদের সকালের বাজার -- বাজারের থলে রান্নাঘরের দুয়ারে ফেলেই দৌড়াবে স্নান করতে, হাপুস হুপুস আওয়াজ তুলে গরম ডাল ভাত তরকারী মাছের ঝোল কোনমতে মতে খেয়েই দৌড়োবে বাস ধরতে, আর দিনের শেষে নেতিয়ে পড়া নটে শাকের মতো ঘর্মক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরবে, দিনযাপনের গ্লানিতে আকণ্ঠ ভরিয়ে।

No comments:

Post a Comment