প্রায় লুপ্ত হওয়া কিছু জীবিকার কথা -- সিঁথী, ১৯৫০-৬৫
শীতের কোনও রবিবারের ভোরে ছাদে পড়তে বসেছি মাদুর পেতে, কখন খুলনা সাতক্ষীরা বসিরহাট হয়ে সূর্যের আলো পৌঁছাবে সিঁথীতে, সেই আশায় বসেছি বই নিয়ে। চাদরে মাথা মুড়ি দিয়ে সামনে বই খুলে জোরে জোরে পড়ছি (মা বলেছেন, নিচ থেকে যেন পড়ার আওয়াজ পাই) কিন্তু কান রয়েছে নিচের রাস্তায়, রসের বাঁকি যেন এসে ফিরে না যায়। এই ঋতুতে বাঁকি অতি সকালে তার বাঁকের আগে পিছে দুই মাটির কলসী ভরে তাজা খেজুর রস নিয়ে আসবে, তাকে দেখলেই গ্লাস আর পয়সা নিয়ে দৌড়াও, রসের শেষ বিন্দুটি গ্লাস উল্টে খাবার পর ঠোঁটে রসের হালকা ফেনা লেগে থাকবে, সেটা চাটার পরই মন তৃপ্ত হবে।
বিকেল পড়তেই পায়ে ঘুঙুর বেঁধে বুকের সামনে টিনের ডাব্বা ঝুলিয়ে ঘুগনী নিয়ে আসতো একজন, তাকে দেখে হুমড়ি খেয়ে পড়তো মেয়ে বৌয়েরা, ছোট শালপাতার ডোঙায় দেওয়া টক-ঝাল-নুনের মশলা ছড়ানো সেই গরম ঘুগনী পাতায় বানানো চামচে খেতে খেতে ঘর্মাক্ত তারা কাপড়ের খুঁটে চোখ-নাক মুছতো, বায়না করতো আরও একটু মশলা ছড়ানোর জন্য।
একটু রাত্রি হলে আসতো একজন কুলফী বেচতে, একটা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বানানো স্ট্যান্ডের ওপর রাখতো মোটা সলতের কুপী আর বড় মাপের কলসীতে বরফের ভেতর থাকতো কুলফী। কুলফীকে টিনের ত্রিকোণ খোলের ভেতর থেকে বের করে, চাকুতে কেটে, তার ওপর মশলা ছড়িয়ে সে কুলফী দেবে ছোট শাল পাতায়, শুনতাম সেই মশলায় নাকি সিদ্ধি মেশানো হতো -- সত্য মিথ্যা জানি না, কেননা ওখানে পাড়ার বড়দের জটলা হতো, ওই পড়ার সময়ে ছোটরা সেখানে থাকতামও না।
দুপুর-বিকেলে আসতো আর একজন, মাথায় একটা বড় আকারের চৌকোণো বাক্স নিয়ে, তার গোল খোপে চোখ রেখে দেখা যাবে রঙীন লন্ডন ব্রীজ, ইফেল টাওয়ার, তাজমহল, লালকেল্লা, কুতুব মীনার আরও কত কি! বাচ্চাদের ভীড়ে ঘেরা থাকতো সেই দুনিয়া দেখানো বাক্স -- কেউ ঝুঁকে, কেউ গোড়ালী উঁচু করে খোপেতে মাথা লাগিয়ে দেখছে সেই বিচিত্র জগত।
সকালের এক প্রাত্যহিক দৃশ্য ছিল দরকারী সরঞ্জাম ভরা একটা কাঠের বাক্স হাতে নিয়ে, কাঁধে একটা ভাঁজকরা চাদর ফেলে, বাঁধা পথে বিশু নাপিতের হনহন করে হেঁটে যাওয়া। তাকে দেখে চায়ের দোকানের কেউ হাঁক দেবে হাত-পায়ের নখ কেটে দেবার জন্য। সময় নষ্ট না করে, জলে নখ ভিজিয়ে অল্প সময়ে বিশু নরুন দিয়ে সুন্দর নখ কেটে দেবে। বাঁধা পারিবারিক গ্রাহক আছে বিশুর, ঘুরে ঘুরে সেসব বাড়িতে গিয়ে ছেলে-বুড়োর চুল-দাড়ি কাটে, পারলৌকিক কাজে বিশুই তাদের ত্রাতা।
বাপঠাকুরের আমলের লাগানো কারোর বাড়ীর নারকেল গাছ এখন প্রতিবছরই কাঁদির ওজনে ঝুঁকে পড়ে -- বাঁধা লোক আছে, সে সময়মতো এসে পায়ে দড়ির ফাঁস লাগিয়ে তরতর করে চড়ে যাবে গাছে, সব নারকেল পেড়ে দেবে। আর খবর দিলেই চলে আসবে সেই লোক যে পুকুরের সব কচুরীপানা উঠিয়ে পুকুর পরিষ্কার করে দেবে -- কচুরীপানার ভেলায় জল বেয়ে সারা পুকুর ঘুরবে আর পাড়ে কচুরীপানার পাহাড় বানাবে। আর যে পুকুরে কলমী হেলেঞ্চা থাকতো, কোথা থেকে বৌ-ঝিয়েরা এসে সে সব তুলে নিয়ে যেত, বাজারে বিক্রির জন্য।
স্ত্রী-বাচ্চা নিয়ে কেউ কেউ আসতো দুপুরের সময়, হাতে থাকতো কাঠের বিরাট রেকাব। খোলা নর্দমার পাঁক তুলে তাতে জল মিশিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ছাঁকতো সেই পাঁকের মাটি, সব শেষের তলানীটুকু সযত্নে একটা পাত্রে ভরে রাখতো সোনার দোকানে বেচবে বলে, যদি তাতে সোনার গুঁড়া থাকে! তাদের পেট-পিঠ এক হওয়া শীর্ণকায় দেহ, রুক্ষ চুল, কোটরগত চোখ, মলিন মুখ দেখলে মনে হতো না ভাগ্য কখনো তাদের প্রতি খুব একটা দয়া দেখিয়েছে। তবুও ঘুরে ঘুরে আসতো, যদি কপালে বড় কিছু থাকে।
বর্ষাকালের সন্ধ্যায় ছাতি আর টর্চ নিয়ে আসতো ২-৩ জন, পুকুর পাড়ে, ঝোপে জঙ্গলে খুঁজে বেড়াতো ব্যাঙ, ধরা পড়লে হাতের ব্যাগে পুড়ে রাখতো তাদের, তাদের পায়ের আওয়াজে ছলাঙ মেরে পালাতো সোনা ব্যাঙেরা। বড়রা বলতো, এই সব ব্যাঙ যাবে রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে, নতুন কোনো ওষুধ মানুষকে দেওয়া যাবে কি না তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা এদের ওপরই আগে করা হবে।
দুপুরের নিস্তব্ধতা ভাঙতো আরও কিছু জীবিকাসন্ধানীর আগমন ঘোষণা -- কেউ দাঁতের পোকা বের করে, কেউ কানের ময়লা পরিষ্কার করে, কেউ পিঠে লুধিয়ানার বিছানার চাদর সস্তায় বেচে। কাপড়ের বদলে বাসন বা কাঁচের বাক্সে আলতা-চুড়ী-সিঁদুর-শাঁখা বেচার লোক সে ও আসবে মাসে ২-১ বার।
ঘুরে ঘুরে আরও অনেকে জীবিকা নির্বাহ করতো। ডুগডুগি বাজিয়ে বিবর্ণ জরীর পোশাকে লায়লা-মজনুর মতো সাজিয়ে তার বাঁদর দুটোর নাচ দেখাতে আসতো বাঁদরবালা, বেতের চুবড়িতে বন্ধ করে সাপুড়ে আসতো বীন বাজিয়ে হিসহিস করা সাপ দেখাতে, ভালুকের নাচ দেখতে তো ভিড় উপছে পড়তো, রাস্তার কুকুররা ভালুক দেখে বেয়াদপী করলেই লোক তেড়ে যেত তাদের ভাগাতে।
স্বাধীনতার পর দেশের খাদ্য সমস্যা প্রায়ই ঘুরে ফিরে মাথা চাড়া দিতো -- কন্ট্রোল/রেশন, লেভী বহুউচ্চারিত শব্দ ছিল। খোলা বাজারে চাল খুব কম লোকেই কেনার ক্ষমতা রাখতো, আর তাদের জন্যই পাশের সীমান্তর ফাঁকফোকর দিয়ে আসতো পাচারের চাল। দুপুরের পর কয়লার ধোঁয়া উড়িয়ে বনগাঁ থেকে আসতো একটা লোকাল ট্রেন। ক্যান্টনমেন্ট ছাড়ার পর দমদমের বাঁকে চেইন টানার জন্য গাড়ী থামতেই পীলপীল করে নেমে আসতো লাইনের পর একশ'র বেশী যাত্রী, সব স্ত্রীলোক, বয়েস ২০-৬০, সবার শাড়ীর নিচে পেটে-পিঠে বাঁধা ১৫-২০ কিলোর চালের ব্যাগ। নেমেই রেললাইন ধরে ছুট সিঁথির পাগলাগারদের আন্ডারপাসের দিকে। শরীরের সেই বোঝা টেনে তারপর রাস্তায় নেমে সিঁথী-বরানগরে নির্দিষ্ট দোকান বাজারে পৌঁছে সেই চাল বেচা। ১৫-২০ কিলো চাল বেচে কেউ মুঠোভর্তি টাকা পেত না, বড়জোর বেঁচে থাকার ন্যূনতম সংস্থানগুলো জোগাড় করতে পারতো। রাস্তায় কেউ কেউ তাদের থেকে আবার পুলিশের ভয় দেখিয়ে পয়সাও নিত। মুখের ভাষায় বোঝা যেত সব পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষ, ছিন্নমূল বা অনুপ্রবেশকারী। ক্লান্তিতে ছাওয়া শরীর, চোখ-মুখে ভয় সংশয়ের মেঘ, কোনো রকমের শাড়ী দিয়ে শরীর আর চালের ব্যাগ ঢেকে তাদের সেই দৌড় এখনো মনে আছে। জীবনযুদ্ধের সেই লড়াই বড় নির্মম ছিল, বহুদূর ঢাকা বা দিল্লী চরম উদাসীনতায় মুখ ফিরিয়ে রাখতো সেই জীবিকার সংঘর্ষে পর্যদুস্ত মানুষগুলির থেকে।
সময় পাল্টেছে, আয়ের সাথে পাল্টেছে মানুষের রুচি ও প্রয়োজন, ভোগবাদী অর্থনীতি ও উৎপাদনে মেশিনের ব্যাপক প্রয়োগ অনেক পুরানো জীবিকার ইতিচ্ছেদ করেছে। বিশু হেরেছে সেলুন/স্পা/পার্লার-এর কাছে, ঘুগনীবালা হেরেছে পীজা/চাউমিনের কাছে, আইসক্রিম পার্লার চোখের ঘুম কেড়েছে কুলফীওয়ালার, খেজুরগাছ লোপাট হোক ক্ষতি নেই, কোক/পেপসী আছে, টিভি ভিডিও থাকতে কে দেখবে বাক্সের ভেতরে মুখ ঢুকিয়ে সেই নীরব ছবি? মাঠ পুকুর ঝোপঝাড় নারকেল গাছ মুড়িয়ে খেয়েছে ডেভলপার, সব ব্যাঙ ধরা হয়ে গেছে -- আর খোলা নর্দমা নেই সোনা খোঁজার জন্য, পুকুর বুজিয়ে ফ্লাট হয়েছে, কচুরীপানা-হেলেঞ্চা-কলমী এখন ছবিতে দেখে ছোটরা। মনোরঞ্জনে জন্তু জানোয়ারের ব্যবহারেও এসেছে অনেক বাধানিষেধ। সব জীবিকা যে একেবারে উধাও হয়েছে তা নয় -- কিছু নেই, কিছু গেছে প্রত্যন্ত জনপদে, যেখানে এখনো বৃহৎ বিপণনের থাবা পড়েনি। টিঁকে আছে সময়ের অপেক্ষায়।
No comments:
Post a Comment