Wednesday, August 18, 2021

কুহেলী আরাবল্লীর হাতছানি (২)

 কুহেলী আরাবল্লীর হাতছানি (২)

ওই যে প্রতি সপ্তাহের শেষে দলে দলে গাড়ি করে সবাই গুজরাট সীমান্ত পেরিয়ে রাজস্থানের আবু পাহাড় বা উদয়পুরের রাস্তায় ছুটে চলেছে, তারা যে সবাই ধর্মপিপাসু বা সৌন্দর্যপিপাসু, তা মনে করার কারণ নেই।
যদিও উদয়পুরের কাছে হিন্দুদের শ্রীনাথজি ও আবু পাহাড়ে দিলবারা জৈনমন্দির আছে --(আমেদাবাদ থেকে দুটোই প্রায় ২৩০ কিলোমিটার) -- কিন্তু বেশিরভাগের পিপাসাটা অন্যত্র, মদিরার টান। গুজরাটে মদ্যপান নিষিদ্ধ (হেলথ পার্মিট ব্যবস্থা আছে, কিন্ত প্রক্রিয়ার জটিলতার জন্য মদিরার গুণগ্রাহীরা সে পথে কম যায়)।
আমেদাবাদ থেকে ১৩০ কিলোমিটার গেলেই শ্যামলাজী, পেরোলেই রাজস্থান সীমান্ত (আবু পাহাড়ে যেতে গেলে তার ৫০ কিলোমিটার আগেই হিম্মতনগর থেকে অন্য রাস্তা)-- সীমান্ত পেরোলেই শুরু নানান মানের মদের দোকান, বার, ধাবা, হোটেল -- যার যেমন সাশ্রয়।
সুতরাং, দল বানাও, চলো শ্যামলাজী সীমান্ত, সকালে পৌঁছিয়ে আকণ্ঠ পান করে, পেট ভরে নিষিদ্ধ ভোজন করে (মানে, চিকেন মাটন) ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসো সন্ধ্যায়। বলা বাহুল্য, সকালে তারুণ্যে ডগমগানো উচ্ছল প্রাণগুলো সন্ধ্যায় ঝিমানো লতার মতো একে অন্যর ঘাড়ে ঝুঁকে পড়া অবস্থায় ফিরে আসে।

আর যদি সপ্তাহের শেষ দিনগুলি কাটাতে চান, তবে বেরিয়ে পড়ুন আবু পাহাড়, দেখে আসুন আরাবল্লীর সব চাইতে উঁচু শৃঙ্গ "গুরুশিখর" (১৭২২ মিটার - - ওই পর্যন্ত আপনার গাড়ি যাবে) -- পাহাড় বনপাদপের শেষে, ছড়ানো সুদূর রুক্ষ প্রান্তরে, দেখবেন দূরে সুতোর মতো বইছে বনাস নদী, নিচের ঘন জঙ্গলে নানান পাখির কলতান, নিচে যাওয়ার জঙ্গলের রাস্তা পাথর দিয়ে বাঁধানো, ভালুক চিতার ভয়ে এক কেউ যায় না নিচের এক মন্দিরে -- কোথাও না গিয়ে প্রাণ ভরে নির্মল বাতাস নিন, দেখুন অরণ্যের বাধনহারা বিস্তার -- শিখরে ভালো বসার জায়গা আছে। নাক্কি লেক-এ বোটে চড়ে সময় কাটাতেও পারেন। পারলে ঘুরে আসুন এগারো শতকের বিচিত্র খোদাইয়ের কারুকাজে সমৃদ্ধ, পাঁচ তীর্থঙ্করের উদ্দেশ্যে নিবেদিত, দিলবারা মন্দির।
তবে এই করোনার উৎপাতে সাত দিনের জন্য বেরিয়ে পড়েছিলাম উদয়পুর। একটা হেরিটেজ হোটেলে আগেই বুকিং ছিল, একদম ফাঁকা, পরিচ্ছন্নতায় কোনোই ত্রুটি নেই, সব উত্তম বাবস্থা।
এর আগেও অনেকবার গিয়েছি উদয়পুর, তবে পরিবারের সবাই একসাথে এই প্রথম। আগেই ঠিক করেছিলাম, ভীড়ের মধ্যে শহরে ঘুরবো না। একদিন গেলাম হলদিঘাট, আরাবল্লীর মালভূমিতে সেই মুঘল-রাজপুত লড়াইয়ের জায়গা (আসলে মুঘলদের হিন্দু সেনাপতি বনাম চিতোরের হিন্দু রানা প্রতাপের লড়াই, same side) -- দুইপাশে সামান্য উচ্চতার হলুদ রঙের বড় টিলা, মাঝখান দিয়ে রাস্তা, লোকে সেই হলুদ মাটির এক টুকরা নিয়ে ফেরে স্মারক হিসেবে। উদয়পুর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটারের দূরত্ব, রাস্তা ভালো মন্দে মেশানো, কাজ চলছে।

হলদিঘাট পোঁছানোর ১৫ কিলোমিটার আগে চলে গেছে কুম্বলগড় যাবার রাস্তা (উদয়পুর থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে)-- সেই রাণাপ্রতাপের জন্ম, ধাত্রী পান্না ইত্যাদি লোকগাথার জায়গা। রাস্তা কিন্তু বেশ ফাঁকা, দুপাশে পাবেন খোলা মালভূমির প্রান্তর, সে সব পেরিয়ে পাবেন জঙ্গলের/পাহাড়ের শুরু। সর্পিল পাহাড়ী পথে আসবে সরু বানাস নদী, পাহাড় থেকে নেমে আসছে হুল্লোড় করে, যেমন স্কুল ফেরত প্রাইমারি স্কুলের কচিরা করে -- বর্ষাকালে সেই ছোট নদীর জল যদি বাঁধানো পুলের ওপর দিয়ে বয়ে যায়, আপনার গাড়ীর টায়ার ধুয়ে দিয়ে, তবে নেমে পড়ুন গাড়ি থেকে, ঠান্ডা প্রবাহে হাত-পা ভিজিয়ে, চোখ-মুখ-মাথায় জলের ছিঁটে দিয়ে, যাত্রার ক্লান্তি দূর করে নিন।
পশ্চিম আরাবল্লীর ওপর নির্মিত, কুম্বালগড়ের দুর্গ রানাকুম্ভ সেই ১৫ শতকে বানিয়েছিল, তাকে ঘিরে রেখেছে ৩৬০০ ফুট উঁচু, ৩৮ কিলোমিটার লম্বা বিশাল এক প্রাচীর, চীনের প্রাচীরের পরেই যার নাম, তার ওপর দিয়ে কম করে আটটা ঘোড়া একসাথে ছুটতে পারে, এমন চওড়া। বলা হয়, গড় বানানো হয়েছিল চিতোরের রানাদের নির্ভয় আশ্রয়ের জন্য, মুঘলদের নাগালের বাইরে। আপনার গাড়ি রাখতে হবে গড়ের বিশাল দরজার বাইরে, বরাতে থাকলে ভালো জায়গা পেয়ে যাবেন। দুর্গের ওপরে পোঁছানো বেশ পরিশ্রমের ব্যাপার, হাঁটুতে চলার অসুবিধা থাকলে সামান্য ওপরে কোনো জায়গায় বসে চারদিকে ছড়ানো মন্দির, বিশাল প্রাচীর আর ধূসর আরাবল্লী দেখুন। ওপরে গেলে দেখবেন সেনাদের ব্যারাক, কামান দাগার জায়গা, জীর্ণ পরিত্যক্ত মহলের অবশেষ, আপৎকালীন প্রস্থানের সিঁড়ি আর সেই ঘর, যেখানে প্রতাপ ভূমিষ্ট হয়েছিল বলা হয়।

No comments:

Post a Comment