Saturday, October 9, 2021

সিঁথীর আরও গল্প – ফ্ল্যাশব্যাক: ১৯৫৫ / ১৯৬০

 

সিঁথীর আরও গল্প – ফ্ল্যাশব্যাক:  ১৯৫৫ / ১৯৬০

 


সিঁথীর মোড় 

জমজমাট সিঁথীর মোড়, সন ২০১৮, এক সকাল ১১টা। ট্রাফিকের লাল বাতি জ্বলতেই ব্রেক-চাকা-রাস্তার ঘর্ষণের চমকানো আওয়াজ তুলে যানবাহন থেমে গেলো সাদা লক্ষণরেখা ছুঁয়ে, রাস্তা পার হওয়ার জন্য জোয়ারের ঢেউয়ের মতো লোক আছড়ে পড়লো রাস্তায়, তার মিনিট খানেক বাদে বাতি নিভলেই ভীমরুলের চাকে যেন ঢিল পড়েছে, বাস ট্যাক্সি মোটর গাড়ী বাইক সব গর্জন করে চলা শুরু করলো।

সিঁথী যাবার রাস্তার ডান দিকে, মানে আগের এম.পি. ষ্টুডিওর উল্টাদিকে কয়েকটি দোকানের সারি, সামনেই একটা ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। (আগে ওখানে ছিল বিরাট পুরানো ভাঙা বাগানবাড়ী  (সিঁথীর মোড় থেকে কালীবাড়ি পর্যন্ত,এত বড় -- বিপরীতে ছিল আরো এক বাগানবাড়ী ও RBT স্কুল)। রাস্তায় ট্যাক্সি না পেয়ে গেলাম সেই স্ট্যান্ডে, একটা খালি ট্যাক্সি সেখানে ছিল। চারদিকে দেখি তৃণমূলের পতাকা টাঙানো, বসে-দাঁড়িয়ে আছে ৪-৫ জন "মুঝে পহেচানো" ভাবভঙ্গীর বাহুবলী। ড্রাইভার না দেখতে পেয়ে তাদের কাছে খোঁজ নিতে গেলে জিজ্ঞাসা করলো কোথায় যাবো আমি। এয়ারপোর্ট যাবো শুনে বললো "চারশো টাকা পড়বে"। বড়জোর ১৫০ টাকার দৌড়, আর ৪০০ টাকা ? বলাতে উপেক্ষার সুরে জানালো "যেতে হলে ওই ভাড়ায় রাজি হোন, নয়তো পথ দেখুন"। দেরী হয়ে গেছে, ইতিমধ্যেই মিনিট তিরিশ নষ্ট করেছি ট্যাক্সির খোঁজে, অগত্যা রাজি হতেই হলো ৪০০ টাকায়।

পঞ্চাশের দশকের শেষভাগে এই সিঁথীর মোড়ের দৃশ্য অন্য ছিল -- মানুষ, যানবাহনের ভীড়তো ছিলই না, কোনো ব্যস্ততাও নজরে পড়তো না।

কাশীনাথ দত্ত রোডের দুপাশে দেখুন। ষ্টুডিওর মুখে চায়ের আর মিষ্টির দোকানটা তখনও ছিল, সামনেই দোকানের ফেলা শালপাতা, মাটির ভাঁড় আর চা পাতা  থেকে জমে ওঠা  ছোট ঢিপি। উল্টা দিকে ছোট বট গাছ ঘিরে ছিল রিক্সা স্ট্যান্ড, লাগোয়া ছিল এক ভাঙাচোরা চায়ের দোকান, যেখানে রিকশাওয়ালারা রুটি-ঘুগনী খেতো দুপুরে-রাত্রে। এর পিছনেই ছিল এক পাঁচিলভাঙ্গা জনহীন বাগানবাড়ী, যার মাঠে ধোবীরা কাপড় শুকাতো। এই  বাগানবাড়ীর লাগোয়া ছিল কার্টার পুলার কোম্পানীর কর্মব্যস্ত কারখানা --সেই সাইকেল-টিফিনবক্স-কাঁধে ঝোলা- হাতে ছাতা নিয়ে শ্রমিকদের পথচলার দৃশ্য, যেমন হতো বেঙ্গল ইম্মুনিটির সামনে। উল্টাদিকের ষ্টুডিওর গল্প আগেই করেছি, অন্য এক প্রসঙ্গে।

বি.টি.রোডের উল্টাদিকে (মানে সিঁথী/ন'পাড়ার দিকে) ছিল টালির চালের কিছু দোকান ও বসত, বাস স্ট্যান্ড লাগোয়া রিক্সা স্ট্যান্ড। ওখানেই ছিল "স্বপ্নশ্রী" নামের এক যাত্রাদল -- প্রায় সন্ধ্যায় হ্যারিকেনের স্বল্প আলোয় রিহার্সাল হতো "গান্ধারী" পালার -- বলরাম আর কৃষ্ণ পরিকল্পনা করছে "কৌরবের শেষ চিহ্ন" মুছে ফেলার, সে কথা কানে যেতেই চোখে পট্টি বাঁধা দ্রৌপদী দুই ভাইয়ের সামনে এসে আহত অভিমানে বললো, "কৌরবের শেষ চিহ্ন আমি, তবে আমায় আগে হত্যা করো"।

মোড়ের মাথায় না ছিল কোনো স্ট্রিট লাইট, ট্রাফিক পুলিশ এসেছিল অনেক পরে। পদ্মজা নাইডু বছরে একবার ব্যারাকপুর গান্ধীঘাটে যেতেন, তখনি সিঁথির মোড়ে দেখা যেত কিছু পুলিশ।

সেই শেষ পঞ্চাশ দশকে সিথীর মোড়ে একটাই ট্রাফিক পুলিশ, বি টি রোডে নামমাত্র ট্রাফিক থাকায় বেশিরভাগ সময় সে আলস্যে হয় গাছের নিচে কিংবা চায়ের দোকানে বসে সময় কাটাতো। ওটা আমার স্কুল যাবার পথ। মাঝে মাঝে দেখতাম পুলিশ বাবু খুব সক্রিয় হয়ে উঠে রাস্তার গাড়ি-ঘোড়া সামলাচ্ছে, ঠিক চৌমাথায় দাঁড়িয়ে। হঠাৎ সে সব যানবাহন দাঁড় করিয়ে দিল, সবাই দেখলো সামনে দুটো মোটরবাইকে সাদা পোশাকের দুটো পুলিশ অফিসার মাঝখানে একটি কালো গাড়ি, আর তার পেছনে একটি পুলিশের গাড়ি। মাঝখানের মোটরগাড়িতে কে আছেন সেটা দেখার আগেই কনভয় দৌড়ে চলে গেল ব্যারাকপুরের দিকে। গাড়িতে ছিলেন রাজ্যপাল শ্রীমতি পদ্মজা নাইডু, প্রতিবছর এই রাস্তা দিয়েই যেতেন ব্যারাকপুর গান্ধীঘাটে, মহাত্মা গান্ধীকে প্রণাম জানাতে। কনভয় চলে যাবার দু মিনিট পরেই রাস্তা যানবাহন আবার স্বাভাবিক হয়ে যেত।

সন্ধ্যার পর মোড়ের বটগাছের নিচে ভূইঁফোড় একটা ছোট মন্দির, আর সেখানেই জমতো এক ছিলিম নেশার আড্ডা, ট্রাফিক পুলিশ ব্যবস্থা চালু হবার পর সে আড্ডা অনেক গোপনে চলতো। পুলিশ আসার পর শুরু হলো ডানলপের দিক থেকে আসা ট্রাক বা মালবাহী বাহনের ড্রাইভারদের থেকে টাকা তোলা -- পুলিশের ইঙ্গিতে একটা ছেলে হাত তুলে দৌড়ে যেত গাড়ির দিকে, ড্রাইভার বা ক্লিনার তার  হাতে বা দূর থেকে ছুঁড়ে দিতো টাকা/আধুলি। সেটা পকেটে পুরে সে পরে রাস্তার এক কোনে গিয়ে  পুলিশের সাথে হিসেবে নিকেশ করতো।

সময়ের সাথে সিঁথির মোড় তার চেহারা চরিত্র পাল্টেছে -- পাল্টায়নি শুধু ওই ষ্টুডিওর গেট ঘেঁষা চা আর মিষ্টির দোকান।

ফুটবল  ক্রিকেট  সাইকেল-প্রতিযোগিতা

সিঁথীর জনজীবনে অনেক বৈচিত্র্য ছিল. কালীতলার বাস স্ট্যান্ডের পাশে খোলা জমিতে ছিল এক পোড়ো ঘর, ইঁটের পাঁজরা বেরিয়ে এসেছে, তার দেয়ালের গায়ে মাথা ওঠাচ্ছে বটগাছ -- একটাই ঘর কিন্তু বেশ বড় মাপের। সেখানেই পাড়ার ছেলেরা বানালো তাদের ক্লাব "শিবনাথ স্মৃতি সংঘ"।

ভেতরে লাইট জ্বালিয়ে সন্ধ্যার পর বড় বুড়োরা তাস ক্যারাম খেলতো, সামনের ছোট জমিতে বানিয়ে ছিল বাহারি ফুলের বাগান -- শীতকালে সূর্যমুখী চন্দ্রমল্লিকারা রূপের হাট বসাতো। ওখানেই হতো পাড়ার সব সার্বজনীন পূজাগুলি। পাশেই ছিল বড় এক পুকুর, যার অর্ধেক ঢাকা থাকতো কচুরিপানা আর তার নীল ফুলে। তার লাগোয়া ছিল ফুটবলের মাঠ -- শিবনাথ স্মৃতি চ্যালেঞ্জ কাপ খেলতে ওই অঞ্চলের বাইরে অনেক দূর দূর থেকে টীম আসতো -- আন্দুল থেকে এসে কাপ জিতে নিয়ে যেত, বনগাঁ থেকে আসতো টীম, বেঙ্গল ইম্মুনিটির টীম খুব লোকপ্রিয় ছিল, বিশেষ করে তাদের ব্যবহার ও সততার জন্য। অনেক দর্শকের মধ্যে এক মাঝবয়েসী নিয়মিত ছিলেন, যার ছিল ফিট-এর ব্যামো। অনিবার্যভাবে  প্রায় সব ম্যাচেই লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই উৎসাহীর কপালে মাথায় বল এসে লাগবে, সে হাত-পা খিঁচিয়ে মাটিতে পরে যাবে, লোকেরা পাশের পুকুরের জল মাথায় ঢেলে তার সম্বিৎ ফেরাবে -- ওদিকে ম্যাচ চলতে থাকবে তার আপন গতিতে, ব্যাপারটা এমনই সামান্যতার পর্য্যায়ে পৌঁছেছিল। ওই মাঠেই ফুটবল খেলে অনেকে পরে কলকাতা লীগের প্রথম ডিভিশনের "ঐক্য সম্মেলনী" টিমে খেলেছে, পেয়ারাবাগানে ছিল সেই ক্লাবের ঘর।

শীতকালে এই মাঠেই টেনিস বলে ক্রিকেট খেলা হতো, বড়রা না থাকলে আমরাও পেয়ারা গাছের ডাল ভেঙে উইকেট বানিয়ে খেলতাম।

শিবনাথের একটা নামকরা বার্ষিক ইভেন্ট ছিল অবিরাম সাইকেল চালানো প্রতিযোগীতা, যে শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যাবে, সে পাবে একটা নতুন সাইকেলের পুরস্কার। রুটটা ঠিক মনে নেই, কিন্তু বৃত্তাকার রুট কালীতলা, ডি.গুপ্ত লেন, ফকির ঘোষ কলোনী আবছা মনে আছে. প্রতিযোগীদের সাইকেলে বসা অবস্থায় জল সরবত দেওয়া হতো, নামার উপায় নেই, স্বেচ্ছাসেবীদের নজর সজাগ। অনেক প্রতিযোগী অংশ নিত, খবরের কাগজের হকাররাতো খুব আশা নিয়ে নামতো -- শুরুতে প্রায় ৩০/৪০ জন প্রতিযোগী থাকতো, সন্ধ্যা বাড়লে কমে অর্ধেক, আর রাত্রিভোরে দেখাযেত বড়জোর ৫/৬ জন ক্লান্ত পায়ে টেনে চলেছে সাইকেল।  যারা পরের দিন সকাল পর্যন্ত টিঁকে থাকতো, তাদের গলায় লোকেরা টাকার মালা, ফুলের মালা পরিয়ে দিতো -- মোটামুটি দ্বিতীয় দিনের দুপুর পেরোতেই দেখা যেত বাকি সবাই থেমে গেছে, একমাত্র যে বহাল আছে, তাকেই বিজেতা বলে ঘোষণা করে মহা ধূমধামে তাকে নিয়ে শোভাযাত্রা বের হতো, আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে পুরস্কার দেওয়া হতো।

পাড়ায় ছিল এক ধোবি, শিবনাথের পেছনের পুকুরপাড়ে বড় মাটির উনুনে মাটির গামলায় কাপড় ফোটাতো সোডা সাবানের গরম জলে, কাঠের পাটাতনের ওপর মুখে চাপা আওয়াজ তুলে কাপড় আছড়াতো, পুকুরের জলে ধুয়ে লম্বা টাঙানো দড়িতে সেই কাপড় শুকাতো। পরে শুকনো কাপড় জামা ইস্তিরি করে সাইকেল নিয়ে বেরোতো ডেলিভারী দিতে। সেই ধোবি পর পর ২ বছর জিতেছিল সেই পুরস্কার -- পুরানো সাইকেল বেচে পুরস্কারের নতুন সাইকেলে চড়ে সে কাপড়ের পোটলা নিয়ে বেরোতো, এখন তার সাইকেলে পুরো চেইন-কভার আছে, ভালো স্প্রিংএর ঘন্টা আছে,ব্যাটারীর লাইট আছে, আছে চওড়া ক্যারিয়ার।

(রানী রাসমণির বাগানবাড়ীর পুকুরেই কালীতলা-ফকিরঘোষ কলোনীর সবাই সাঁতার শিখতো, বড়োরা বাঁধানো ঘাটের উঁচু চাতাল থেকে লাফ মারতো, এপার ওপার করতো। এক বোরো দুর্ঘটনায় এখানেই জলে ডুবে মারা যায় ফকিরঘোষ কলোনির এক তরুণ -- সে এক বড় দুঃক্ষজনক ঘটনা। এখন আর নেই সেই শিবনাথের মাঠ, আম সুপারি পেয়ারা নারকেল গাছ ঘেরা বাগানবাড়ি, নেই সেই ছায়াঘেরা পুকুর -- সব এখন বাড়িঘরে ভরা) ।

নেতাজীর জন্মদিন -- পহেলা বৈশাখ 

প্রতি বছর নেতাজীর জন্মদিনে সিঁথীতে প্রভাতফেরী হতো। প্রায় ২০ ফুট উঁচু পরিচিত যুদ্ধবেশে সজ্জিত নেতাজীর এক বিশাল মাটির মূর্তি ট্রাকে করে নিয়ে সুন্দর সুশৃঙ্খল শোভাযাত্রা বের হতো। গাড়ীর আগে থাকতো ছোটদের ব্যান্ড-কুচকাওয়াজের দল -- সাদা জামাকাপড়, কোমরে বেল্ট, সাদা জুতা, মাথার কালো টুপীর ওপর রঙিন পালক -- কারোর হাতে ব্যান্ড, কারোর হাতে বাঁশী -- সব চাইতে সামনের ছেলেটার হাতে একটা ছড়ি -- চলেছে গান গাইতে গাইতে "উর্ধ্বগগনে  বাজে মাদল"। নেতাজীর তেজভরা দীপ্ত মুখ দেখে কিশোরে মন বলতো, আমি থাকলে ছুটে যেতাম ইম্ফলে, দিল্লীর যাত্রা অবশ্যই শেষ করতাম। পহেলা বৈশাখেও প্রভাতফেরী হতো, মাইক্রোফোন লাগিয়ে অল্প বয়েসী উজ্জ্বল মেয়েরা লালপেড়ে সাদাশাড়ী পড়ে ট্রাকের ওপর বসে-দাঁড়িয়ে তাদের লম্বা বিনুনী দুলিয়ে গান গাইতো,"এসো হে বৈশাখ এসো এসো"। আর পূজার পর পাড়ায় পাড়ায় হতো বিজয়া সম্মেলনী, গান বাজনা নাটক আবৃত্তিতে ভোরে উঠতো সন্ধ্যাগুলো। কোথায় গেলো সে  সামূহিক আনন্দউৎসবের দিনগুলি!

ভোটের কড়চা

ভোটের ঢাকে কাটি পড়তেই সিঁথি-বরানগরে সাজো সাজো রব উঠতো। দেয়ালে ছাপানো পোস্টার আটা-ময়দার আঠা দিয়ে লাগাও, রঙীন চিত্রকারী করো দেয়ালে পাঁচিলে, দলের প্রতীক এঁকে ও প্রার্থীর নাম লিখে। ষাটের শুরুতে তার সাথে যুক্ত হলো স্লোগান লেখা, তথ্য দিয়ে প্রতিপক্ষকে কাবু করা, ব্যঙ্গ চিত্র আঁকা ইত্যাদি। পার্টি অফিসে যাও, দেখবে মাটিতে বসে সমর্থকেরা একের পর এক পোস্টার লিখছে, চায়ের দোকান থেকে মাঝে মাঝে আসছে মাটির ভাঁড়ে চা, চা শেষে সেই ভাঁড়কেই ছাইদান বানানো হতো, বিড়ি চারমিনারের ধুঁযায় ঘর ভরে যেত।

রাত্রেই হতো পোস্টার ব্যানারের কাজ, দিনে হতো শোভাযাত্রা মিটিং পথসভা গণসংযোগ। নির্বাচন বিশেষে ওদিকে সুশীল পাল, এদিকে গণপতি সুর, ডানলপের ওপরে রাধিকা ব্যানার্জী, টালার ওপারে লক্ষী সেনরা সক্রিয় হয়ে উঠতো সমর্থকদের সাথে।

পাড়ায় পাড়ায় ঘরে ঘরে গিয়ে ভোটদাতাদের সাথে প্রত্যক্ষ গণসংযোগ রাখা পঞ্চাশের দশকে খুব সাধারণ ঘটনা ছিল। প্রার্থী তার দলবল নিয়ে হেঁটে বা সাইকেল চড়ে ছোট ছোট শোভাযাত্রা নিয়ে ঘুরতেন, হাত জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে ভোট ভিক্ষা করতেন -- জোড়া-বলদ কিংবা কাস্তে-ধানের-শীষ আঁকা দলীয় পতাকা নিয়ে।

কালীতলার বাঙালবাড়ীতে অনেক ভোট, সবাই জানতো। কর্পোরেশনের নির্বাচনে গণপতি সুর বাঁধা প্রার্থী ছিলেন কংগ্রেসের  এবং জয়ীও হতেন। লাভ নেই জেনেও উনি বাঙালবাড়ীতে আসতেন, সবার সাথে হাসিমুখে শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন, হাত মেলাতেন। ওপারের কাশীপুরে কংগ্রেস প্রার্থী  সুশীল পাল অনেক ভোট জিততেন, এপারের গণপতি সুরের মতোই। কিন্তু চট্টগ্রাম মামলার সাথে জড়িত বিপ্লবী গনেশ ঘোষ বিধানসভার নির্বাচনে কমিউনিস্ট প্রার্থী হয়ে দাঁড়াতেই সিঁথীর রাজনৈতিক সমীকরণ পাল্টে গিয়েছিলো, বামপন্থীদের প্রভাব ধীরে ধীরে বেড়েছিল।

সংসদীয় গণতন্ত্রের শুরুর দিকে নির্বাচন নিয়ে নোংরামী বদমায়েশী বা হাতাহাতির রেষারেষি হতো না, কে কাকে ভোট দেয় সেটা মোটামুটি সবার জানা থাকতো। কিন্তু ভোটের পর তেমন তিক্ততা থাকতো না। বাঙালবাড়ীর লোকেরা রেশন কার্ড বা ইলেকট্রিক কানেক্শনের ব্যাপারে যখনই সুপারিশের জন্য গেছে ওনার বাড়ীতে, গণপতি সুর বিনা প্রশ্নে আবেদনপত্রে সুপারিশ করে দিতেন।

Wednesday, September 22, 2021

এই তো সেদিন

 এই তো সেদিন 


বাঁধের পশ্চিমে তখন সূর্য ঢলো ঢলো. পায়ের খুরে বাঁধের মাটি উড়িয়ে বাথানে ফিরছে গরুর পাল, তাদের পিছনে বারো'মাইলের হাট থেকে মাথায় পোটলা নিয়ে ফিরছে কয়েকজন। পাশের কাদুয়া'দির কঞ্চির বেড়াতে ঝিঙ্গার লতায় হলুদ ফুলের পসরা,  ভোমরারদল তাদের শেষ মধুটুকুও শুষে নিয়ে গেছে। এখন আমার পড়তে যাবার সময়, প্রায় আধ মাইল দূরে, মোক্ষদা'র কাছে। মোক্ষদা একা থাকে তার তালপাতা দিয়ে বানানো এক চালের মাটির ঘরে। প্রায় সত্তরের কাছাকাছি সে, সামান্য ঝুঁকে চলে, মাথায় সাদা চুল, ফর্সা মুখে কপালে বয়েসের ভাঁজ। গ্রামের লোকের দয়াতেই সে বেঁচে আছে। দিনের বেলায় তাকে দেখেছি আমার মা'র কাছেও আসতে, সাদা কাপড়ের খুঁটে বেঁধে নিয়ে যেত চাল বা আনাজ। মোক্ষদা স্বাক্ষর ছিল, তাই মা তার কাছেই পাঠাত আমার বর্ণ পরিচিতির জন্য। প্রায় ওড়িষ্যা ঘেঁষা বলে বাংলা না, ওড়িয়াতে ছিল মোক্ষদার প্রাথমিক শিক্ষা, আর আমাকেও সে ওড়িয়াতেই অ আ শেখাতো।
হাতে স্লেট-পেন্সিল নিয়ে বাঁধের রাস্তা ধরে সন্ধ্যায় হেঁটে যাওয়া উঠতি পড়ুয়ার। ওপারের প্রান্তজুড়ে পড়ে থাকা ধানের ক্ষেত, ক্যানালে বাঁশের নোঙ্গরে বাঁধা ডিঙি নৌকা, ঘুঁটের ধোঁয়ার আস্তরণে আস্তে আস্তে ভারী হচ্ছে চারপাশ, বেঁটে নীমগাছের গোড়ায় কেউ জ্বালিয়ে গেছে প্রদীপ। বিশাল বটের কাছে যেতেই ওপরে পাখীদের চেঁচামিচি, নিচের মাটির চাতালে গল্প গুজব শেষ করে বুড়োরা যে যার ঘরে ফিরে যাবার পথে।
তালপাতার চাটাইয়ে বসে স্লেটে মোক্ষদার লেখা অ আ'র ওপর হাত বোলাচ্ছি, পাশে মাটির ঊনানে মাটির সানকিতে গরম বালীতে মুড়ী বানাচ্ছে মোক্ষদা, বাঁশের চোঙ্গায় ফুঁ দিয়ে আগুনের আঁচ বাড়াচ্ছে মাঝে মাঝে। ঘুঁটের আগুনের আঁচে থেকে থেকে খুব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে তার মুখে কপালে সময়ের দাগগুলো। দারিদ্র বা আপন-পর বোঝার বয়েস ছিল না সেই আমার, কিন্তু মোক্ষদাকে আমার খুব ভালো লাগতো, ভালো  লাগতো সে যখন ময়লা স্লেট ময়লা মুছে আবার নতুন করে হরফ লিখে দিতো, ভালো লাগতো যখন সে কাপড়ে মুখ মুছতে মুছতে এগিয়ে দিতো আমার দিকে গরম মুড়ির বাটী বা আমার  থুতনীতে হাত দিয়ে স্নেহ প্রকাশ করতো।।
প্রায় এক ঘন্টার পর বাড়ি ফেরার সময়। ততক্ষনে বিশাল বটগাছে পাখীর চেঁচামেচী শেষ, কেবল থেকে থেকে বাদুড়ের পাখার ঝাপ্টার শব্দ। ফণীমনসার ঝোপে কোন সরীসৃপের আসা-যাওয়া, কার আঙিনায় বিশ্রাম নিচ্ছে সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে ধান ভাঙার ঢেঁকি, আঁধারে ঢেকে গেছে ও পাড়ের ধানের ক্ষেত, কাদুয়া'দির ঝিঙার বেড়ায় তখন অজস্র জোনাকীর আনাগোনা।
রাতে মায়ের পাশে শুয়ে ঘুম ভেঙে গেলে অন্ধকারে মা'র মুখ দেখে ভাবতাম, আমার মা'র মুখে কপালেও  কি একদিন ভাঁজ পরবে, ঝুঁকে চলবে ? আর সেই সাথে এক প্রশ্ন, মোক্ষদা কেন একা থাকে, আমাদের সাথেও তো থাকতে পারে!
এখন আমিও স্বাক্ষর কিন্তু ছোটবেলার সব প্রশ্নের উত্তর এখনো পেলাম না।

Sunday, September 12, 2021

গাড়ীর নাম মাহাত্ম

 গাড়ীর নাম মাহাত্ম

যেমন আপনার নামই আপনার পরিচয়, তেমনি গাড়ীর নম্বর প্লেটও তার নাম, তার পরিচয় -- তার রেজিস্ট্রেশন বই হলো তার আধারকার্ড।
পশ্চিম বাংলার নম্বর প্লেট নিয়ে অন্য রাজ্যে ঢুকুন, ট্রাফিক পুলিশ এমন ভাবে আপনাকে দেখবে যেন আপনি গাড়ী চুরি করে পালাছেন ভিনদেশে। গুজরাটের ভাড়া ট্যাক্সি নিয়ে জয়পুর গেছিলাম, ট্রাফিক পুলিশ ড্রাইভারের সব কাজগপত্র ঘেঁটে কিছু গোঁজামিল না পেয়েও খসখস করে চালান খাতায় এক হাজার টাকার জরিমানা লিখে দিলো। কি কারণ ? ভাড়ার ট্যাক্সি ড্রাইভার কেন তাদের জন্য নির্দিষ্টকরা পোশাক ( সেটা কি জানি না) পড়েনি, সেই জন্য, মানে, সেই বাঘ-ছাগলের গল্প -- তুই জল ঘোলা করিসনি তো তোর বাপ বা ঠাকুরদা করেছে, তোকে আমি খাবই। বিভিন্ন রাজ্যে পরিবহন ও ট্রাফিকের আলাদা আলাদা কানুন, সবাই কি তার খোঁজ রাখে? সাধারণে জরুরী কাগজপত্র (রেজিস্ট্রেশন, বীমা, PUC, রোড ট্যাক্স আর ড্রাইভিং লাইসেন্স) নিজের সাথেই রাখে, ভিনরাজ্যে গেলে বিশেষতঃ। কিন্তু হাজার কানুনে যে আপনি বাঁধা, সেটা জানেন কি ?
আহমেদাবাদে ঢোকার মুখেই পুলিশ চৌকি, জাতীয়সড়কের বাঁকে ওতপেতে বসে আছে পুলিশ, অন্য জেলার বা রাজ্যের নম্বর দেখলে ইশারাতে রাস্তার পাশে ডেকে নেবে, নানা কানুনে আপনাকে পরখ করবে, যদি ট্রাক হয় তবে কপালে আরও দুঃক্ষ, পুরা ট্রাক তল্লাশি করবে -- কিছু না পেয়ে নিখরচায় যেতে দেবে, এমনটা খুব কম হয়।
শুনেছিলাম, উদয়পুরে নাকি গুজরাটের গাড়িকে পাশ দিয়ে এগিয়ে যাবার পথ ছাড়ে না, পরে নিজের অভিজ্ঞতায় বুঝেছিলাম, যা রটে তার কিছুটা তো বটে!
রক্তের সম্পর্ক বড় সম্পর্ক। ভিনরাজ্যে রাস্তায় আপনার গাড়ীর কোনো যান্ত্রিক বিভ্রাটে আপনার রাজ্যের কোনো গাড়ীর চালক দেখলে, তার থেকে সহায়তা পাবেন, কিছু পেট্রলের প্রয়োজনে, গাড়ীর টায়ার পাল্টাতে বা ওই জাতীয় কিছু প্রয়োজনে।
"নামে কি আসে যায়" যে বলেছিলো, তার গাড়ি ছিলোনা, তার কথা বাদ দিন, গাড়ীর বেলায় সেই কথা খাটে না।

Tuesday, August 24, 2021

কুহেলী আরাবল্লীর হাতছানি (৩)

 

কুহেলী আরাবল্লীর হাতছানি (৩)

একবার উদয়পুরে ঠাইঁ নিয়েছেন তো একটা বড় সুবিধা হলো, আসেপাশের ভ্রমণের জায়গাগুলো দেখার জন্য সকালে বেরিয়ে সন্ধ্যায় ফেরা যায় বিনা ক্লান্তিতে। যেমন একশো কিলোমিটারের সামান্য বেশি দূরত্বের চিত্তোরগড়, হাইওয়ে এতই মসৃন ও বাধাহীন যে মনে হবে কোনো বিমানবন্দরের রানওয়ে। চিত্তোর যাবার আগে তার ব্যাপারে একটু পড়াশোনা করে নিলে ভালো হয়, যদিও দেখবেন স্থানীয় গাইডরা মাছির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। অষ্টম শতাব্দীর এই রাজপূত রাজধানী ভারতের সব চাইতে বড় দুর্গ ছিল সারা চিত্তোরগড় আপনি গাড়ি নিয়ে ঘুরতে পারবেন, এক রাস্তায় প্রবেশ ও অন্য রাস্তায় নির্গমন। দেখুন মীরার মহল ও মন্দির, জহরব্রতের জায়গা, নানান মন্দির, পদ্মিনীর মহল ও জলাশয় (এবার গিয়ে দেখলাম সেই আয়নাটা গায়েব, যাতে পদ্মিনীর প্রতিচ্ছবি দেখে আলাউদ্দীন এক নম্বর কমান্ডমেন্ট ভঙ্গ করেছিল) - - ফেরার পথে অবশ্যই কিছুটা সময় দেবেন "সুরজপোল"-এ,  আক্রমণকারী দিল্লীর মালিকেরা(আফগান ও মুঘল) এই পথেই ঢুকতো দুর্গ জয় করার জন্য, প্রতি অধ্যায়ের শেষ হতো জহরব্রত দিয়ে।

উদয়পুর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে আছে "রাজসামান্দ লেক". শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার এগোলেই পড়বে এক অভয়ারণ্য, ঘন জঙ্গলে দুপাশ ঢাকা, আড়াল থেকে তীক্ষ্ণস্বরে ডেকে পাখার ঝাপ্টা মেরে পালিয়ে গেলো নাম না জানা পাখী, কোথাও জলাশয়ের পাড়ে এক চক্ষু বুজে দাঁড়িয়ে আছে ঢ্যাঙা এক ভিনদেশী বক, নির্জন নিঃসঙ্গ আলোআঁধারী পরিবেশ। কিছুক্ষন পরেই আসবে "রাজসামান্দ লেক", পাহাড়ের কোলে ছড়ানো --  এক সুন্দর শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে যাকে ছবির মতো দেখায়। সতেরোশ শতকে মেবারের রানা রাজসিং নির্মাণ করেছিলেন এই লেক। সুন্দর শ্বেতপাথরে বাঁধানো ঘাটে বসে দেখুন চারপাশের ছবি, কাঁচের মতো টলটল পরিষ্কার জলে দেখুন ভেসে যাওয়া মেঘের ছায়া আর থেকে থেকে জল থেকে ছলাঙ মারা রুপালী মাছেদের হুটোপুটি।

হালদিঘাট যুদ্ধের পরেও দুই দশক বেঁচে ছিলেন প্রতাপ, নতুন রাজধানী বানিয়েছিলেন উদয়পুর থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে, চাভান্ড গ্রামে, রাজসামান্দ থেকে ৩০ কিলোমিটারের মতো দূরে, সরু রাস্তা ধরে ছোট ছোট গ্রামের মধ্যে দিয়ে গাড়ির রাস্তা। চাভান্ড থেকে দুই কিলোমিটার দূরে, বাডোলি গ্রামে, এক নদীর পাড়ে প্রতাপের শেষকৃত্য করা হয়। লোকালয় থেকে অনেক দূরে থাকা এই সমাধিতে কিছুক্ষন সময় কাটান, সেই পরাক্রমী রাজপুতের স্মরণে। এই জায়গা সাধারণ পর্যটকদের জানার বাইরে, কোনোদিন উদয়পুর আসলে অবশ্যই খোঁজ নেবেন।

সাতদিনের প্রোগ্রাম শেষ, ঘরে ফেরার সময় এলো -- সকালে হোটেলে প্রাতঃরাশ সেরে রওনা দেওয়া আহমেদাবাদের রাষ্ট্রীয় সড়ক মার্গে, রাস্তায় কেনা হলো বার্গার ব্রেড চীজ বিস্কুট ইত্যাদি, সাথে আছে ফ্লাস্কের গরম জল আর টি-ব্যাগ। অনেক ভালো জায়গা পাবেন রাস্তায় জিরোবার জন্য, এখন তো আর তাড়া নেই.ঘরে ফেরার। গান্ধীনগর ঢুকতেই পড়ন্ত বিকেলে, আর ২০ কিলোমিটার পরেই আহমেদাবাদ।

মাথায় এখন আছে হয় জয়সলমীর (৩ দিন যথেষ্ট) নয়তো ধোলাভিরা (হরাপ্পা সংস্কৃতির অবশেষ, বিরাট বৃষ্টির জল ধরে রাখা কুয়া ইত্যাদি) ছুঁয়ে কচ্ছ সীমান্ত আদি ঘুরে আসা (৪/৫ দিন ধরে রাখুন) -- নয়তো ইন্দোর-বিদিশা-সাগর- এলাহাবাদ-হাজারীবাগ-কলকাতা-আহমেদাবাদের (এটা প্রায় ২২০০ কিলোমিটার, সব মিলিয়ে দিন কুড়ির ভ্রমণ।


Wednesday, August 18, 2021

কুহেলী আরাবল্লীর হাতছানি (২)

 কুহেলী আরাবল্লীর হাতছানি (২)

ওই যে প্রতি সপ্তাহের শেষে দলে দলে গাড়ি করে সবাই গুজরাট সীমান্ত পেরিয়ে রাজস্থানের আবু পাহাড় বা উদয়পুরের রাস্তায় ছুটে চলেছে, তারা যে সবাই ধর্মপিপাসু বা সৌন্দর্যপিপাসু, তা মনে করার কারণ নেই।
যদিও উদয়পুরের কাছে হিন্দুদের শ্রীনাথজি ও আবু পাহাড়ে দিলবারা জৈনমন্দির আছে --(আমেদাবাদ থেকে দুটোই প্রায় ২৩০ কিলোমিটার) -- কিন্তু বেশিরভাগের পিপাসাটা অন্যত্র, মদিরার টান। গুজরাটে মদ্যপান নিষিদ্ধ (হেলথ পার্মিট ব্যবস্থা আছে, কিন্ত প্রক্রিয়ার জটিলতার জন্য মদিরার গুণগ্রাহীরা সে পথে কম যায়)।
আমেদাবাদ থেকে ১৩০ কিলোমিটার গেলেই শ্যামলাজী, পেরোলেই রাজস্থান সীমান্ত (আবু পাহাড়ে যেতে গেলে তার ৫০ কিলোমিটার আগেই হিম্মতনগর থেকে অন্য রাস্তা)-- সীমান্ত পেরোলেই শুরু নানান মানের মদের দোকান, বার, ধাবা, হোটেল -- যার যেমন সাশ্রয়।
সুতরাং, দল বানাও, চলো শ্যামলাজী সীমান্ত, সকালে পৌঁছিয়ে আকণ্ঠ পান করে, পেট ভরে নিষিদ্ধ ভোজন করে (মানে, চিকেন মাটন) ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসো সন্ধ্যায়। বলা বাহুল্য, সকালে তারুণ্যে ডগমগানো উচ্ছল প্রাণগুলো সন্ধ্যায় ঝিমানো লতার মতো একে অন্যর ঘাড়ে ঝুঁকে পড়া অবস্থায় ফিরে আসে।

আর যদি সপ্তাহের শেষ দিনগুলি কাটাতে চান, তবে বেরিয়ে পড়ুন আবু পাহাড়, দেখে আসুন আরাবল্লীর সব চাইতে উঁচু শৃঙ্গ "গুরুশিখর" (১৭২২ মিটার - - ওই পর্যন্ত আপনার গাড়ি যাবে) -- পাহাড় বনপাদপের শেষে, ছড়ানো সুদূর রুক্ষ প্রান্তরে, দেখবেন দূরে সুতোর মতো বইছে বনাস নদী, নিচের ঘন জঙ্গলে নানান পাখির কলতান, নিচে যাওয়ার জঙ্গলের রাস্তা পাথর দিয়ে বাঁধানো, ভালুক চিতার ভয়ে এক কেউ যায় না নিচের এক মন্দিরে -- কোথাও না গিয়ে প্রাণ ভরে নির্মল বাতাস নিন, দেখুন অরণ্যের বাধনহারা বিস্তার -- শিখরে ভালো বসার জায়গা আছে। নাক্কি লেক-এ বোটে চড়ে সময় কাটাতেও পারেন। পারলে ঘুরে আসুন এগারো শতকের বিচিত্র খোদাইয়ের কারুকাজে সমৃদ্ধ, পাঁচ তীর্থঙ্করের উদ্দেশ্যে নিবেদিত, দিলবারা মন্দির।
তবে এই করোনার উৎপাতে সাত দিনের জন্য বেরিয়ে পড়েছিলাম উদয়পুর। একটা হেরিটেজ হোটেলে আগেই বুকিং ছিল, একদম ফাঁকা, পরিচ্ছন্নতায় কোনোই ত্রুটি নেই, সব উত্তম বাবস্থা।
এর আগেও অনেকবার গিয়েছি উদয়পুর, তবে পরিবারের সবাই একসাথে এই প্রথম। আগেই ঠিক করেছিলাম, ভীড়ের মধ্যে শহরে ঘুরবো না। একদিন গেলাম হলদিঘাট, আরাবল্লীর মালভূমিতে সেই মুঘল-রাজপুত লড়াইয়ের জায়গা (আসলে মুঘলদের হিন্দু সেনাপতি বনাম চিতোরের হিন্দু রানা প্রতাপের লড়াই, same side) -- দুইপাশে সামান্য উচ্চতার হলুদ রঙের বড় টিলা, মাঝখান দিয়ে রাস্তা, লোকে সেই হলুদ মাটির এক টুকরা নিয়ে ফেরে স্মারক হিসেবে। উদয়পুর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটারের দূরত্ব, রাস্তা ভালো মন্দে মেশানো, কাজ চলছে।

হলদিঘাট পোঁছানোর ১৫ কিলোমিটার আগে চলে গেছে কুম্বলগড় যাবার রাস্তা (উদয়পুর থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে)-- সেই রাণাপ্রতাপের জন্ম, ধাত্রী পান্না ইত্যাদি লোকগাথার জায়গা। রাস্তা কিন্তু বেশ ফাঁকা, দুপাশে পাবেন খোলা মালভূমির প্রান্তর, সে সব পেরিয়ে পাবেন জঙ্গলের/পাহাড়ের শুরু। সর্পিল পাহাড়ী পথে আসবে সরু বানাস নদী, পাহাড় থেকে নেমে আসছে হুল্লোড় করে, যেমন স্কুল ফেরত প্রাইমারি স্কুলের কচিরা করে -- বর্ষাকালে সেই ছোট নদীর জল যদি বাঁধানো পুলের ওপর দিয়ে বয়ে যায়, আপনার গাড়ীর টায়ার ধুয়ে দিয়ে, তবে নেমে পড়ুন গাড়ি থেকে, ঠান্ডা প্রবাহে হাত-পা ভিজিয়ে, চোখ-মুখ-মাথায় জলের ছিঁটে দিয়ে, যাত্রার ক্লান্তি দূর করে নিন।
পশ্চিম আরাবল্লীর ওপর নির্মিত, কুম্বালগড়ের দুর্গ রানাকুম্ভ সেই ১৫ শতকে বানিয়েছিল, তাকে ঘিরে রেখেছে ৩৬০০ ফুট উঁচু, ৩৮ কিলোমিটার লম্বা বিশাল এক প্রাচীর, চীনের প্রাচীরের পরেই যার নাম, তার ওপর দিয়ে কম করে আটটা ঘোড়া একসাথে ছুটতে পারে, এমন চওড়া। বলা হয়, গড় বানানো হয়েছিল চিতোরের রানাদের নির্ভয় আশ্রয়ের জন্য, মুঘলদের নাগালের বাইরে। আপনার গাড়ি রাখতে হবে গড়ের বিশাল দরজার বাইরে, বরাতে থাকলে ভালো জায়গা পেয়ে যাবেন। দুর্গের ওপরে পোঁছানো বেশ পরিশ্রমের ব্যাপার, হাঁটুতে চলার অসুবিধা থাকলে সামান্য ওপরে কোনো জায়গায় বসে চারদিকে ছড়ানো মন্দির, বিশাল প্রাচীর আর ধূসর আরাবল্লী দেখুন। ওপরে গেলে দেখবেন সেনাদের ব্যারাক, কামান দাগার জায়গা, জীর্ণ পরিত্যক্ত মহলের অবশেষ, আপৎকালীন প্রস্থানের সিঁড়ি আর সেই ঘর, যেখানে প্রতাপ ভূমিষ্ট হয়েছিল বলা হয়।

Sunday, August 8, 2021

কুহেলী আরাবল্লীর হাতছানি (১)

 

কুহেলী আরাবল্লীর হাতছানি (১)

(Internet-এ এই বিষয়ে অনেক ছবি ও ভিডিও থাকায়, এই লেখাতে আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহ পরিহার করেছি -- অনেক বেশি ভ্রমণ বিবরণও পাবেন সার্চ করলে)

COVID -এর বাধানিষেধ অসহ্য হলেই মেয়ে আর নাতি নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম আরাবল্লীর আশ্রয়ে। একবার না, একাধিকবার। আমেদাবাদ থেকে আরবল্লী আপনি ৭-৮ ঘন্টায়  ছুঁয়ে ফিরে আসতে পারেন (শ্যামলাজী, পোলো'র জঙ্গল বা তরঙ্গা পাহাড় ), কমবেশি ১৫০ কিলোমিটার।  সময় থাকলে সীমানা পেরিয়ে রাজস্থানে দিনও কাটাতে পারেন (আবু পাহাড়, উদয়পুর, কুম্বলগড়, হালদিঘাটি বা রাজসমুদ্র'লেক), কমবেশী ৩০০ কিলোমিটারের দূরত্ব। গুজরাট ও রাজস্থানের সব রাস্তাই মসৃণ চওড়া, সড়কপথে যাত্রা যন্ত্রণাদায়ক না, রাস্তার পাশে আছে অনেক উত্তম ধাবা, যার খাবার ও স্বচ্ছ পরিবেশ সপরিবারে ভ্রমণের উপযুক্ত।যাতায়াতের অন্য সাধারণ ব্যবস্থা থাকলেও, নির্ঝঞ্ঝাট হয় নিজেদের গাড়ি থাকলে।

সেই হরিয়ানা থেকে প্রায় ৭০০ কিলোমিটার পথ হেঁটে, দিল্লী রাজস্থান হয়ে, গুজরাটের আবুতে যাত্রা শেষ করেছে আরাবল্লী, হিমালয়ের থেকেও যার বয়েস বেশি। তার কাঁটা ঝোপ ঝাড় জঙ্গলে আশ্রয় দিয়েছে হরপ্পা সভ্যতার বিস্তার, অনেক অনেক বৌদ্ধ গুফায় গুঞ্জিত হয়েছে মানুষ ও জীবের মঙ্গল কামনার প্রার্থনা, হিন্দু ও জৈন মন্দির তো আছেই। তার কোনে কোনে এখনো লুকানো অদেখা অজানা অতীতের অনেক অনাবিষ্কৃত রহস্য, ঘন কাঁটাভরা বাবুলের আঁচলে যা চোখের আড়ালে ঢাকা রয়েছে। এই আরাবল্লী আবার বর্ষার ছোঁয়ায় সবুজে সেজে ওঠে, অতি অপরূপা তখন সে -- তার গা বেয়ে নেমে আসে ছোট বড় বর্ষাতি নদী, পাদদেশের শুষ্ক নিঃস্নেহ ঊষর প্রান্তরে শ্যামলীমা আনতে।

শ্যামলাজীর মন্দির এই মন্দিরে গদাধর বিষ্ণু আনুমানিক হাজার বছর বিরাজমান, মন্দিরের বাইরের দেয়ালের কারুকাজ দেখে অবাক হবেন, এমন সুন্দর। এর পরেই রাজস্থানের চেকপোস্ট, রাস্তা গেছে উদয়পুরের দিকে। সময় থাকলে খোঁজ করুন আশেপাশের প্রাচীন বৌদ্ধ মঠের -- একটার খোঁজ পেয়েছিলাম, কিন্ত বিবরণে অতি দুর্গম জেনে দেখা হয় নি

পোলো'র জঙ্গল প্রায় এক হাজার বছরের আগে পরিহার বংশের রাজা এখানে তার রাজধানী বানিয়ে ছিলেন, হার্নাভ নদীর পাশে, ৪০০বর্গ কিলোমিটার ছড়ানো এই গুজরাট-রাজস্থান সীমান্তের ঘন জঙ্গলে - - বলা হতো, এখানে মাটিতে সূর্যেরআলো পৌঁছায় না, এমনই ছিল সবুজের আস্তরণ। পরিত্যক্ত এই শহরে আছে খুব সুন্দর প্রাচীন শিব মন্দির, জৈন মন্দির। জঙ্গলে কান পেতে শুনুন হর্নবিল বা বার্বেটের কণ্ঠস্বর, রাত্রে চিতা ভালুক হায়েনা তাদের উপস্থিতি জানায়।

তরঙ্গা পাহাড়। আরাবল্লীর এক বিস্তার এই পাহাড় ভিন প্রদেশের পর্যটকদের কাছে খুব পরিচিত না, বেশখানিটা নির্জন রাস্তা পেরিয়ে পৌঁছতে হয়, তারপরেই সেই কাছে আসার হাতছানি। পাহাড়ী রাস্তার দুপাশে ঘন জঙ্গল, এক পাস দিয়ে এক ক্ষীণতনু এক স্রোতস্বিনী নিজের তালে নেমে আসছে। উঁটের পিঠের মতো উতরাও-চড়াও পথের শেষে মিলবে জৈনদের এক প্রসিদ্ধ মন্দির। ফিরে যান সমতলে, একটু এগিয়েই পাবেন পুরানো বৌদ্ধ গুফা, সরকারী প্রকল্পে যার সংস্কার চলছে। উঁচুতে পাহাড়ের ওপরে আছে আরও এক বৌদ্ধ সাধনা স্থল, জঙ্গলে ঢেকে গেছে সেখানে পৌঁছানোর পথ

এই হলো পাহাড়ের একপাশের গল্প, গুজরাটের। ও পাশের গল্প করবো পরের বার।